মাসের বিশেষ দিনগুলোর আগে প্রি-মেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম বা পিএমএস (Premenstrual syndrome – PMS) এ ভুগতে হয় না এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া ভার। হয়ত হুট করে খেয়াল করলেন গত দুই-তিন দিন ধরে মেজাজটা একটু খিটখিটে হয়ে আছে। নাকি কারণে-অকারণে হঠাৎ খারাপ হয়ে যাচ্ছে মন? রাগ উঠে যাচ্ছে দুম করে? ভালো করে খেয়াল করে দেখুনতো আপনার পিরিয়ডের ডেট কি সামনেই?
ওপরের প্রশ্নগুলোর বেশির ভাগের উত্তরই যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে বলতেই হবে, আপনি প্রি-মেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোমে আক্রান্ত, সংক্ষেপে যাকে বলে ‘পিএমএস’।
আসুন তাহলে এ বিষয়ে জেনে নেয়া যাক টুকিটাকি কিছু জরুরী কথা।
পিএমএস কী ও কারণ
এটি মেয়েদের খুব সাধারণ আর পরিচিত একটি সমস্যা। মন-মেজাজের তারতম্যের পাশাপাশি পেটব্যথা, মাথাব্যথা কিংবা হাতপায়ের জ্বলুনি- এসব সমস্যাও দেখা যায় প্রায়ই। এ ধরনের শারীরিক অস্বস্তি বা মানসিক অস্থিরতা আসলে ঘটে থাকে হরমোনের তারতম্যের কারণে।
মেয়েদের শরীরে হরমোনের এই তারতম্যকে দু’টো ফেইজ বা পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। পিরিয়ড শুরুর প্রথম দিন থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত সময়টায় যে হরমোনের আধিক্য বেশি থাকে, সেটা মেয়েদের জন্য বন্ধুসুলভ। নির্ঝঞ্ঝাট এই হরমোন শরীর বা মনের ওপর বিশেষ কোনো চাপ তৈরি করে না, বাধা দেয় না স্বাভাবিক চলাফেরা বা দৈনন্দিন কাজে।
এর পরবর্তী সময়ে, মানে মাসিকের ১৫ বা ১৬ দিনের পরেই যে হরমোনগুলোর পরিমাণ শরীরে বাড়তে শুরু করে, সেগুলোই মূলত পিএমএসের জন্য দায়ী। সাধারণত পিরিয়ডের ১৯ দিনের পর যেকোনো সময়ই দেখা দিতে পারে পিএমএসের লক্ষণ।
পিএমএস – লক্ষণসমূহ
- অবসাদ
- খিটখিটে মেজাজ ও বিষণ্ণভাব
- স্তনে পরিবর্তন
- অতিরিক্ত ব্রণ ওঠা
- ক্লান্তিভাব
- কন্সটিপেশন অথবা ডায়রিয়া কিংবা বদহজম
- পেট ফাঁপাভাব বা গ্যাস হওয়া
- মাথা ব্যথা
- পেটে ব্যথা বা অস্বস্তিভাব
- বার বার অমনযোগী হয়ে যাওয়া
- দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
- খাবারে অরুচি বা ক্ষুদা মন্দাভাব
প্রতিকারের উপায়
১) হালকা ব্যায়াম করুন।
২) অল্প অল্প করে কিন্তু বারে বারে খাবার খান।
৩) ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার খান, যেমন- চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, কাজু, পেস্তার মতো একমুঠো রকমারি বাদাম।
৪) ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার বর্জন করুন।
৫) পটাশিয়াম যুক্ত খাবার খান, যেমন- ফ্রেশ ফলের সালাদ, কমলার রস কিংবা মিক্সড সবজি।
৬) ক্যাফেইন, অ্যালকোহল বা মিষ্টি জাতীয় খাবার অ্যাভয়েড করুন।
৭) দুধ বা দুধের তৈরি খাবার খান।
৮) বেশি পরিমাণে চিনি দিয়ে তৈরি খাবার বা মিষ্টি জাতীয় খাবার শরীরকে ক্লান্ত করে দ্রুত, তাই বর্জন করুন।
৯) গরু বা খাসির মাংস, রিফাইন্ড খাবার যেমন-কেক, পেস্ট্রি, মিষ্টি, কোলা বা সোডা জাতীয় খাবার বা পানীয় থেকে দূরে থাকুন।
১০) ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার খান, যেমন- লাল চালের ভাত বা রুটি, ব্রকোলি, বাদাম, জলপাই, পেঁপে, কুমড়া-এগুলোয় ভিটামিন ই-এর পরিমাণ অনেক বেশি।
১১) ম্যাগনেশিয়াম জাতীয় খাবার খান, যেমন-অনেক ধরনের দানাজাতীয় খাবার ও বাদামে ম্যাগনেশিয়াম পাওয়া যায়, পাশাপাশি লাল চালেও। পিএমএস-এর কারণে সৃষ্ট পেটব্যথা, মাথাব্যথা, অস্বস্তি, ক্লান্তিভাব ও অবসন্নতা কাটাতে ম্যাগনেশিয়াম সাহায্য করে।
১২) প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে, দিনে অন্তত ৭-৮ গ্লাস।
১৩) চিকিৎসকের পরামর্শমত প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, হরমোনাল, ভিটামিন বা অন্য ওষুধ সেবন করতে পারেন।
পরিবারকে হতে হবে সাপোর্টিভ
এই সময়ে মেয়েরা অন্যদের ভুল ধরে, অন্যদের সমালোচনা করে, অন্যদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে, খিস্তি খেউর করে। পারলে দুনিয়া উলটে ফেলতে চায়। কারণ এই সময়ে মেয়েরা যা কিছু চিন্তা ভাবনা করে তাঁর প্রায় পুরোটাই কল্পনার জগত। বাস্তবের সঙ্গে সেইসব কল্পনার খুব একটা অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এই সময়ে মেয়েরা খুব ইমোশনাল হয়ে যায়। তাই এই সময়ে পরিবারের সাপোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পিএমএস-এর সময়ে যেকোন শারীরিক এবং মানসিক সমস্যায় মেয়েদের পরিবারের সদস্য বিশেষ করে অন্য নারীদের সাথে শেয়ার করা উচিত। উপসর্গগুলো অতিরিক্ত হলে, অবশ্যই একজন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
মেয়েদের উচিত তাঁর পরুষ সঙ্গীটিকে পিএমএস-এর সময়ে তাঁর কী কী বিরূপ আচরণ হতে পারে সে সম্পর্কে আগে ভাগেই একটা ধারণা দেওয়া। নাইলে প্রতি মাসের পিএমএস-এর সময়ের মেয়েদের এ ধরনের বিরুপ আচরণ থেকে অনেকের ঘর ভাঙারও কারণ হতে পারে। পুরুষ সঙ্গীটিকে আগে থেকে বুঝিয়ে দিলে সঙ্গী পুরুষটি বিষয়টি বুঝতে পেরে সে অনুযায়ী সামাল দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। মানসিক চাপ কমাতে পছন্দের গান শোনা, পছন্দের জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, পছন্দের কেনাকাটা করা ভালো। অতঅএব পিএমএস সম্পর্কে মেয়েদের পাশাপাশি পূর্ণ বয়স্ক পুরুষদের ও সঠিক ধারণা থাকা উচিত। মোটকথা নিজের ভালো লাগার কাজ করলে পিএমএস-এর অস্বস্তিকর সময় পাড়ি দেয়া কোন ব্যাপারই নয়। আশপাশের মানুষগুলোর একটু ধৈর্যশীল থাকাই তখন মেয়েটির জন্য স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরী করে।
বিশ্বাস রাখুন নিজের উপর
নারীরা আজ ঘরে বাইরে কোথাওই কোন কাজে পিছিয়ে নাই। মাসিক এবং মাসিক পূর্ববতী শারীরিক ও মানসিক সমস্যাও খুবই স্বাভাবিক একটি সমস্যা। এ নিয়ে লজ্জা, সংকোচের কিছু নেই। এটি লুকিয়ে রাখারও কোন কারণ নেই। তাই স্কুল, কলেজ, কর্মস্থল, পরিবার- সবজায়গাতেই পিএমএস ব্যাপারটিকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যাপার হিসাবে নিতে হবে এবং নারীর জন্য সহমর্মী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সর্বপোরি নিজের উপর আত্মবিশ্বাস থাকলে যে কোন দূর্গম পথ মোকাবেলা করা সহজ হয়ে যাবে।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; ইমেজেসবাজার.কম