মাস কয়েক আগেই খালেক সাহেব সপরিবারে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন, থমকে গিয়েছিল তাদের জীবন। পরিবারের বাকি সবাই পরিত্রাণ পেলেও খালেক সাহেবের বাবা রেহাই পাননি করোনা ভাইরাসের প্রাণঘাতী আগ্রাসন থেকে। তাই পরিবারে এখনো শোকের ছায়া। টুকটাক করে সবাই চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও কোথায় যেন ছন্দ পতন ঘটেছে। আগের মতো বাজার হাতে সিঁড়ি বেয়ে চার তলায় উঠতে পারেন না খালেক সাহেব। ঘিরে ধরেছে বিষণ্নতা, পোস্ট কোভিড সিনড্রোম এ রাতে ঠিকঠাক ঘুমটাও হচ্ছে না। ডায়াবেটিসটাও যেন হয়েছে লাগাম ছাড়া, দু’বেলা ইনসুলিন নিয়েও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। অথচ আগে কোনো ঔষধ ছাড়াই শুধুমাত্র ডায়েট, ডিসিপ্লিন আর নিয়মিত কায়িক পরিশ্রমেই রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকতো খালেক সাহেবের।
কোভিড পরবর্তী এমন চিত্র যেন আজ ঘরে ঘরে। কোভিড থেকে মুক্তি মিললেও, কোভিড-১৯ পরবর্তী জটিলতা যেন পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। অপেক্ষাকৃত কম বয়েসীদের মাঝে এমন সমস্যা কম দেখা দিলেও বয়োজ্যেষ্ঠরা এ নিয়ে বেশ ভুগছেন। পোস্ট কোভিড সিনড্রোম বা কোভিড পরবর্তী সময়ে শারীরিক জটিলতা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর তান্ডব
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। সার্স-কোভ-টু নামের এই আর এন এ ভাইরাসটি সৃষ্ট রোগটির নামকরণ করা হয় করোনা ভাইরাস ডিজিজ-১৯ বা কোভিড-১৯। ২০১৯ সালে শনাক্ত হলেও বিশ্বব্যাপী এর তান্ডব আমরা দেখতে পাই ২০২০ সালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে ১১ মার্চ, ২০২০। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। এর মাঝে কোভিড পরবর্তী জটিলতা উল্লখযোগ্য। কোভিড পরবর্তী ফলো-আপে আসা রোগীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কিছু শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন পোস্ট কোভিড সিনড্রোম বা লং কোভিড সিনড্রোম। চলুন তবে পোস্ট কোভিড সিনড্রোম সম্মন্ধে আজ কিছুটা জেনে নেই।
কেন হয় পোস্ট কোভিড সিনড্রোম?
করোনা ভাইরাস আক্রমণে দেহের ইমিউন সিস্টেম ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভাইরাসকে ধ্বংস করতে প্রচুর পরিমাণে কেমিক্যাল মেডিয়েটরস ক্ষরণ হয়, এর মধ্যে ইন্টারলিউকিন-৬ এর নাম টা হয়তো কেউ কেউ শুনেছেন। কেননা কোভিড রোগীদের প্রায়শই এই পরীক্ষাটি করতে দেয়া হয়। সে যাই হোক! ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শরীরের ইমিউন সিস্টেম এক সময় অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করতে শুরু করে। এ লড়াইয়ে শরীরের কিছু কোষও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্বাসতন্ত্র।
কাদের হতে পারে এমনটা?
যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এমন কেউ কিংবা ক্যান্সার রোগী, কেমোথেরাপি পাচ্ছেন, এ ধরনের রোগীদের মাঝে লং কোভিড সিনড্রোম বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রোগীর কোভিড আক্রান্ত অবস্থায় রোগের তীব্রতার সাথে লং কোভিড সিনড্রোমের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। মানে হলো তীব্র সংক্রমিত রোগী থেকে মৃদু সংক্রমণ যেকোনো ক্ষেত্রেই পোস্ট কোভিড সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। কেননা অপেক্ষাকৃত কমবয়েসী, নীরোগ, মৃদু সংক্রমিত হয়েছিলেন এমন রোগীদেরও দেখা যাচ্ছে যে কোভিড পরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন।
পোস্ট কোভিড সিনড্রোম
কোভিড পরবর্তী সময়ে শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এই সময়ে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, সেগুলোই এখন আমরা জানবো।
১) ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম
মাইটোকন্ড্রিয়া একটি কোষের শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র বা কোষের পাওয়ার হাউজ নামে পরিচিত। কোভিডে প্রচুর পরিমাণে মাইটোকন্ড্রিয়াল ইনজুরি হয়। তাই নিয়মিত শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হয়। সেই সাথে অক্সিডেটিভ স্টেস আর মেটাবলিক প্রক্রিয়ার অস্বাভাবিকতা তো আছেই। যার ফলে রোগীরা কোভিড থেকে সেরে উঠলেও সীমাহীন দুর্বলতা অনুভব করেন। অল্প কাজ করেই হাপিয়ে ওঠেন। সেই সাথে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যেতে থাকে।
২) শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা
প্রাথমিকভাবে করোনায় ফুসফুস আক্রান্ত হয়। এতে প্রদাহের ফলে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো বাতাসের বদলে পানি পূর্ণ হয়ে যায়, তাই বায়ুথলিগুলো এদের স্বাভাবিক কাজ অর্থাৎ রক্তের অক্সিজেনেশন ঠিকঠাক করতে পারে না। কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পরও এই বায়ুথলিগুলো সেরে উঠতে অনেক সময় লাগে। কোনো কোনো জায়গায় এর দেয়াল পুরু ও শক্ত হয়ে যায়। মেডিকেলের ভাষায় যাকে বলে পালমোনারী ফাইব্রোসিস। একবার ফাইব্রোসিস হয়ে গেলে সে টিস্যুগুলো আর স্বাভবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। ফলে দেখা দেয় রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা হাইপোক্সিয়া, শ্বাসকষ্ট, ঘনঘন শ্বাস নেওয়া, দীর্ঘমেয়াদি কাশি ইত্যাদি সমস্যা।
৩) হৃদযন্ত্রের ও রক্তনালীর জটিলতা
কোভিড পরবর্তী সময়ে দ্রুত হৃদ স্পন্দন, হার্ট ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া করোনা ভাইরাসের রক্তনালীর অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বাঁধানোর যে প্রবণতা সেটি রয়ে যেতে পারে অনেকদিন পর্যন্ত। হতে পারে পোস্ট কোভিড স্ট্রোক কিংবা পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। এজন্যই বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত রক্ত তরলীকরণের ঔষধগুলো কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পরও একমাস পর্যন্ত সেবন করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা, অবশ্যই সেটা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে।
৪) কোভিড পরবর্তী মানসিক জটিলতা
দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি বা আইসোলেটেড থাকা, বিশেষ করে যারা HDU কিংবা ICU তে ছিলেন, সেখানকার ভীতিকর স্মৃতি থেকে অনেকেই পরবর্তীতে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এ ভোগেন। অনেকেই অভিযোগ করেন ছোট খাটো ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন। সাথে খিটখিটে মেজাজ, দুশ্চিন্তা, অবসাদ তো আছেই। এখানে অবশ্য কোভিডে প্রিয়জন হারানো কিংবা চিকিৎসার পেছনে অতি কষ্টের সঞ্চয়টুকু ফুরিয়ে যাবার ব্যথাও দায়ী অনেকাংশে।
৫) এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিক ডিসঅর্ডার
করোনা ভাইরাস অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষে আক্রমণ করে। তাই প্রচুর পরিমানে বিটা কোষ ধ্বংস হয় এবং ইনসুলিন ক্ষরণ হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।
৬) প্রজনন স্বাস্থ্যে প্রভাব
পোস্ট কোভিড সিনড্রোমে অনেক পুরুষদের মাঝে সাব-ফার্টিলিটি ও ইরেক্টাইল ডিসফাংশন দেখা দেয়। এছাড়া অনেক মহিলারা কোভিড পরবর্তী সময়ে অনিয়মিত মাসিক সমস্যায় ভুগছেন, এটি পরোক্ষভাবে প্রজনন স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।
৭) চর্মরোগ
কোভিড পরবর্তী ত্বকের উজ্জ্বলতা হারানো, অতিমাত্রায় চুল পড়া, মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে লালচে র্যাশ, পিগমেন্টেশন, চুলকানো এগুলো নিয়ে রোগীরা প্রায়শই চিকিৎসকদের কাছে আসছেন।
৮) ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনেকেই স্বাদ ও গন্ধ পায় না। কারণ এটা সরাসরি আমাদের ভাইটাল সেনসরি অর্গানে (vital sensory organ) প্রভাব ফেলে। কোভিড নেগেটিভ হলেও অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ঘ্রাণশক্তি অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
তাহলে পরিত্রাণের উপায়?
- কোভিড নেগেটিভ হবার পর চিকিৎসকের পরামর্শে ফলো-আপে থাকা
- শ্বাসতন্ত্রের জটিলতার জন্য চেস্ট ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে
- ত্বক ও চুলের যত্নে ভিটামিন সি যুক্ত ফল-মূল ও বেশি বেশি শাক-সবজি অর্থাৎ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা
- প্রয়োজনে ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ
- পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমনঃ মাছ, মাংস, ডিম,দুধ,বা দাম ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখা
- পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা মানসিক সমস্যার উপসর্গ দেখা দিলে সাইকিয়াট্রিস্ট এর পরামর্শ বা কাউন্সেলিং সেশনে অংশ গ্রহণ করা
- স্মেল সেন্স কমে গেলে নাকের কাছে কড়া গন্ধযুক্ত দ্রব্য রেখে সেটার ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করা
শেষকথা
এতো কথার পরও আমি বলবো “Prevention Is Better Than Cure” তাই সচেতন হোন। জনসমাগম এড়িয়ে চলুন, মাস্ক পরুন, অন্তত ৩০ সেকেন্ড ধরে হাত পরিস্কার করুন। আর হ্যাঁ! অবশ্যই সপরিবারে টিকা গ্রহণ করুন, অন্যকেও টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করুন। আজ এখানেই শেষ করছি। আবারও চলে আসবো নতুন কোনো বিষয় নিয়ে। ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক