একজন নারীর জীবনে সন্তান ধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। পুরো পরিবার নতুন অতিথির আগমনী বার্তার অপেক্ষায় থাকে। সন্তান ধারণ থেকে শুরু করে তাকে পৃথিবীর আলোতে মুখ দেখানো পর্যন্ত পুরো জার্নিটা অনেক দূর্গম। একজন মাকে অনেক বিপদ পাড়ি দিতে হয়। তেমনি একটি বিপদের নাম প্রি-এক্লাম্পসিয়া (Pre-eclampsia – PE) বা গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ। গর্ভাবস্থায় অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয়। নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে না থাকলে অবস্থা জটিল হয়ে যেতে পারে। তাই আসুন আজ জেনে নেই গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ বা প্রি-এক্লাম্পসিয়া কী?
গর্ভাবস্থায় অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয়। আবার অনেকের আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ থাকে, গর্ভাবস্থায় সেটি নিয়মিত হয়। প্রি-এক্লাম্পসিয়া উচ্চ রক্তচাপজনিত একটি সমস্যা যা শুধুমাত্র গর্ভবতী মায়েদের হয়ে থাকে। শতকরা ৫-১৫ ভাগ নারী গর্ভাবস্থায় এই সমস্যায় ভুগতে পারেন।
গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর যদি কারো উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে (এ সময় গর্ভবতী মহিলার রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি. অব মারকারির চেয়ে বেড়ে যায়) এবং ইউরিনের সাথে প্রোটিন বা এলবুমিন যায় তবে এই উপসর্গকে প্রি-এক্লাম্পসিয়া বলা হয়।
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
১) উচ্চ রক্তচাপ (১৪০/৯০ মি.মি. বা তাঁর বেশি)। রক্তচাপ ১৬০/১১০ মি. মি. বেশি হলে মারাত্মক প্রি-এক্লাম্পসিয়ার লক্ষণ।
২) হঠাৎ করে শরীরে পানি আসতে পারে বা শরীর ফুলে যেতে পারে।
৩) মাথা ব্যথা বা ক্রমশ প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হওয়া এবং মাথার পেছনে বা সামনে প্রচণ্ড ব্যথা।
৪) চোখে ঝাপসা দেখা।
৫) উপরের পেটে প্রচণ্ড ব্যথা (ডান পাঁজরের নিচে)।
৬) মাথা ভারি হয়ে যাওয়া বা ঝিম ঝিম লাগা।
৭) প্রস্রাব কমে যাওয়া বা গাঢ় রঙের প্রস্রাব হওয়া।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
১. যাদের পূর্বে একবার প্রি-এক্লাম্পসিয়া হয়েছে।
২. প্রি-এক্লাম্পসিয়া পরিবারে কারোও হলে।
৩. পরিবারে কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলে।
৪. যারা বেশি বয়সে মা হন তাদের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৫. উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কিডনির সমস্যা আছে এমন রোগীদের।
৬. দুটো সন্তান প্রসবের মাঝে ১০ বছর বা তার বেশি ব্যবধান থাকলে।
৭. গর্ভবতী মায়ের অতিরিক্ত ওজন থাকলে।
চিকিৎসা
(১) প্রি-এক্লাম্পসিয়া আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে।
(২) খাবারের সঙ্গে আলাদা লবণ খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
(৩) প্রোটিন এবং ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেতে হবে।
(৪) পুষ্টিকর নরম খাবার খেতে হবে।
(৫) রাতে গড়ে ৮ ঘন্টা এবং দিনে ২ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
(৬) পা ফুলে গেলে পা দুটো বালিশের উপর উঁচু করে রেখে ঘুমাতে হবে।
(৭) ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ এবং প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে।
(৮) রক্তচাপ, ওজনের চার্ট তৈরি করতে হবে।
(৯) প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন যাচ্ছে কিনা তার চার্ট করতে হবে।
(১০) বাচ্চার অবস্থা জানার জন্য আল্ট্রাসনো করাতে হবে।
(১১) শরীর খারাপ লাগলে দেরি না করে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে বিপদসমূহ
মায়ের বিপদ
– খিঁচুনি বা এক্লাম্পসিয়া।
– কিডনি, হৃৎপিণ্ড, যকৃত এবং মস্তিষ্কে উচ্চ রক্তচাপের জন্য রক্ত সরবরাহ কমে যায় যার ফলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি রেনাল ফেইলিওর হতে পারে।
– গর্ভফুল জরায়ু থেকে পৃথক হয়ে যাবার ফলে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে মায়ের মৃত্যুও হতে পারে।
– গর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমে যাওয়া।
– সময়ের পূর্বে বাচ্চা প্রসব।
– মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।
গর্ভস্থ শিশু বা নবজাতকের বিপদ
– কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ।
– অপরিণত শিশু।
– গর্ভের শিশু তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ উচ্চ রক্তচাপ থাকলে মায়ের প্লাসেন্টাতে রক্তপ্রবাহ কমে যায়।
– গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধি ধীর হয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া।
– গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু।
প্রতিরোধে করণীয়
১) যারা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের রোগী তাদের প্রথমেই সতর্ক হতে হবে।
২) গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত চেকআপ-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা উচিত।
৪) নিয়মিত রক্তচাপ মাপা।
৫) প্রসাবে প্রোটিন যায় কিনা পরীক্ষা করা।
৬) রক্তশূন্যতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করা।
৭) হাতে-পায়ে পানি আছে কিনা ইত্যাদি পরীক্ষা করা।
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ
আপনাকে যদি নিয়মিত রক্তচাপ কমানোর ওষুধ খেতে হয় এবং সে অবস্থায় আপনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন, তবে অবশ্যই আপনার ডাক্তারকে জানান। ডাক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী আপানার ওষুধ বদলে দিবেন। গর্ভবতী মায়েরা ওষুধ খেতে অনেক ভয়ে থাকেন যে ওষুধ গর্ভজাত সন্তানের ক্ষতি করবে কিনা। অতিরিক্ত ওষুধ আসলেই ক্ষতি করতে পারে কি? হ্যাঁ, করতে পারে। তবে চিকিৎসকগণ যেসব ওষুধ গর্ভাবস্থায় দেন, সেগুলো কোন বাচ্চার সমস্যা করে না। গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে এমন অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ দেয়া হয় যেগুলো বাচ্চার কোনো সমস্যা করে না। হয়তো উচ্চ রক্তচাপের কারণে সমস্যা হবে, তবে ওষুধের কারণে সমস্যা হবে না।
মনে রাখতে হবে
১. নিয়মিত চেকআপ, প্রেগনেন্সির সময়ে নিরাপদ ওষুধ এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে আগে থেকেই গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
২. ওজন স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে কী খাবেন এবং কতটুকু পরিশ্রম করবেন জেনে নিন। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হোন।
৩. খাবারে বাড়তি লবণ এড়িয়ে চলুন।
৪. দুশ্চিন্তা রক্তচাপ বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত মেডিটেশন, যোগাসন বা হালকা ব্যায়াম আপনাকে এ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
বাসায় নিয়মিত প্রেশার মাপার ব্যবস্থা করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। আর তা না হলেও নিয়ম মেনে রক্তচাপের ওঠানামা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তবেই সুস্থ থাকবেন গর্ভবতী মা, আর জন্ম দেবেন সুস্থ শিশু। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবি- সংগৃহীত: theasianparent.com, shutterstock