বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে সারা বিশ্বে ২.৩ মিলিয়ন নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। একই বছর মারা যান প্রায় ৬৮৫০০০ জন আক্রান্ত নারী। ২০১৫-২০২০ সাল পর্যন্ত স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে ছিলেন ৭.৮ মিলিয়ন রোগী। এই সংখ্যাগুলো দিয়ে আমরা অনুমান করতে পারি স্তন ক্যান্সারের ব্যাপকতা কতটা বেশি। তাই এই বিষয়ে সচেতন থাকা খুবই জরুরি। ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কী কী, সেটা আমাদের সবারই জেনে রাখতে হবে।
আমাদের দেশে কিছু রোগ নিয়ে ট্যাবু বা সামাজিক গোঁড়ামি কাজ করে। স্তন ক্যান্সার তার মাঝে অন্যতম। লক্ষণগুলো দেখা দিলেও অনেকে এড়িয়ে যান। যার ফলে মৃত্যুর মতো করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। কিন্তু কিছু কমন লক্ষণ দেখেই ঠিকমতো চিকিৎসা নিলে হয়তো বেঁচে যেতে পারতো আপনার প্রিয় মানুষটির প্রাণ। তাই নিজে সচেতন হতে হবে, পাশাপাশি অন্যকেও জানাতে হবে।
ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে যতকথা
বয়স বাড়ার সাথে সাথেই মূলত স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্তন ক্যান্সার ৫০ বছর বয়সের পরেই ধরা পড়ে থাকে। যেসব নারীরা উত্তরাধিকারসূত্রে জেনেটিক ত্রুটি বা অস্বাভাবিক মিউটেশন পেয়েছেন, যাদের ফ্যামিলিতে ক্যান্সারের হিস্ট্রি আছে মানে মা, বোন বা কাছের কেউ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে অন্যদের তুলনায়।
কীভাবে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়?
জেনেটিক মিউটেশন বা ডিএনএ-এর অস্বাভাবিকতার ফলেই সাধারণত স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকে। যেমন- বিআরসিএ১ ও বিআরসিএ২ জিনের কারণে ক্যান্সার হতে পারে। একজন মানুষ যখন শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে, তখন তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অস্বাভাবিক ডিএনএ-এর বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে থাকে। কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যায়, তখন তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একদম কমে আসে, এ কারণে তখন ইমিউন সিস্টেম অস্বাভাবিক ডিএনএ বৃদ্ধিকে কন্ট্রোল করতে পারে না। সেক্ষেত্রে, স্তনের টিস্যুর মাঝে কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে শুরু করে, আর এই অত্যধিক কোষ বৃদ্ধি টিউমার গঠন করে থাকে যা আশেপাশের কোষগুলোকে পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করে। এভাবেই দেহে ক্যান্সারের সূত্রপাত!
এখন জেনে নিই ক্যান্সারের ধরন নিয়ে
ক্যান্সারের রকমভেদ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও মূলত ছয়ভাবে ক্যান্সার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। সেগুলো হচ্ছে-
- কারসিনোমা
- সারকোমা
- মায়েলোমা
- লিমফোমা
- লিউকেমিয়া
- মিক্সড বা মিশ্র টাইপ ক্যান্সার
ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কী?
স্তন ক্যান্সার যদি প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায় সেক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায় এবং সার্ভাইভালের চান্সও বাড়ে। তাই অবহেলা না করে প্রাথমিকভাবেই রোগটি শনাক্ত করে ডাক্তারের শরনাপন্ন হোন। এখন জেনে নেওয়া যাক প্রাথমিকভাবে কী কী লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে এটি স্তন ক্যান্সার।
১. প্রথমত, একটি পিন্ড আপনার নজরে আসবে যা স্তনের আশেপাশের কোষ থেকে আলাদাভাবে অনুভব করা যায়।
২. স্তনের চামড়া হঠাৎ করে মোটা হওয়া বা ফুলে যাওয়া।
৩. স্তনের আকার, আকৃতি বা শেইপের পরিবর্তন হওয়া।
৪. স্তনবৃন্ত (এরিওলা) ভেতরে ঢুকে যাওয়া ও স্তনের ত্বকের চারপাশের অংশে খোসা খোসা ওঠা, চামড়াতে ডিম্পলিং বা ভাঁজ দেখা দেওয়া।
৫. বুকের দুধ ছাড়া নিপল দিয়ে রক্তসহ লিকুইড বের হওয়া।
৬. বগল বা স্তনের যেকোনো স্থানে ব্যথা বা জ্বালা অনুভূত হওয়া।
৭. কমলার খোসার মতো ব্রেস্টের স্কিনে গুঁটি গুঁটি দাগ বা লালচেভাব দেখা গেলে তা স্তন ক্যান্সারের উপসর্গ।
এই লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি দৃশ্যমান হলে বা স্তনে কোনো শক্ত পিন্ড দেখা দিলেই দেরি না করে ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হবে।
ক্যান্সার আক্রান্ত স্তনের থেকে কীভাবে স্বাভাবিক স্তনকে আলাদা করবেন?
ক্যান্সার আক্রান্ত স্তনে মূলত শক্ত মাংসপিন্ড থাকবে এবং এই পিন্ড সাধারণত ব্যথাহীন। স্তন ফুলে যাবে অস্বাভাবিকভাবে। স্তনবৃন্ত বা স্তনের ত্বকে পরিবর্তন ও লালচেভাব দেখা যাবে। নিপলস থেকে তরল স্রাব বের হবে। এর মাধ্যমেই একটি সাধারণ স্তন থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত স্তনকে সহজেই আলাদা করা যায়। তবে এগুলো ব্রেস্ট টিউমারেরও লক্ষণ হতে পারে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শে টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হবে যে ক্যান্সারের জার্ম আছে কিনা।
আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত লজ্জা বা ভয়ের কারণে ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলেও কাউকে না জানিয়ে বা ডাক্তারের শরনাপন্ন না হয়ে চুপচাপ থাকে, এ কারণেই দিন দিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। তাই সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং সবাইকে এই বিষয়ে জানাতে হবে। আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকবেন সবাই।
ছবি- সাটারস্টক