সোরিয়াসিস ত্বকের একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। এতে ত্বকের কোষগুলোর জীবনচক্র দ্রুত শেষ হতে থাকে। ফলে ত্বকের ওপর বাড়তি কোষের একটি বোঝা জমে ওঠে। এতে ত্বকের স্থানে স্থানে খসখসে, লাল বা সাদাটে হয়ে যেতে পারে, ফেটে যায়। ত্বক মাছের আঁশের মতো খসখসে হয়ে পড়ে। এটি একটি অটো ইমিউন প্রদাহ। শীতকালে এই রোগ বেশি বাড়ে। এর সঙ্গে শরীরের আরও নানা রোগের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, হৃদ্রোগ, অন্ত্রের রোগ ইত্যাদি। বংশগত রোগের সম্পর্কও আছে। চলুন তবে জেনে নেই সোরিয়াসিস রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত!
সোরিয়াসিস রোগ নিয়ে যত কথা
সোরিয়াসিস রোগ হবার কারণ
সোরিয়াসিস কেন হয়, তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। চলুন তবে জানা যাক-
১) বংশগত কারণে
সোরিয়াসিস হবার একটি কারণ হলো জিনগত বা বংশগত কারণ।
২) ইমিউন সিস্টেম
সোরিয়াসিস হবার আরেকটি কারণ হলো অটো ইমিউনিটি। আমাদের শরীরের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এর একটি বিচ্যুতি ঘটে তা সোরিয়াসিস রোগে প্রভাব ফেলে।
৩) স্থূলতা
সোরিয়াসিস হবার একটি অন্যতম কারণ হলো স্থূলতা। যত স্থূল হবে, সোরিয়াসিস তত বাড়বে। তাই ওজন কমিয়ে রাখতে হবে।
৪) ট্রমা বা দুর্ঘটনা
সোরিয়াসিস রোগ হবার অপর একটি কারণ হলো ট্রমা বা দুর্ঘটনা। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনায় ধরুন ত্বক ছিলে গেল, পুড়ে গেল, ব্যথা পেল বা রোদে পুড়ে গেল, এই ধরনের পরিবেশগত দুর্ঘটনা কিন্তু সোরিয়াসিসকে বাড়ায়। তাই দুর্ঘটনা থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে।
৫) মানসিক চাপ
খুব মানসিক চাপ সোরিয়াসিস রোগ বাড়ায়। মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। দরকার হলে ওষুধ খেতে হবে।
এছাড়াও ধূমপান, মদ্যপান সোরিয়াসিস বাড়ায়। অনেক ধরনের ওষুধ রয়েছে, রোগী খেতে পারবেন না। খেলে সোরিয়াসিস বাড়বে। সে সব ঔষধ সম্পর্কে চিকিৎসক ভালো ধারণা দিতে পারবেন।
সোরিয়াসিস রোগ সংক্রমণের স্থান
সোরিয়াসিস কেবল ত্বক নয়, আক্রমণ করতে পারে শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও। সাধারণত কনুই, হাঁটু, মাথা, হাত ও পায়ের নখ আক্রান্ত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে মাথার ত্বক আক্রান্ত হতে পারে এবং হাতের নখের রঙ নষ্ট হয়ে যায় এবং গর্ত হয়ে যায়।
কতটা সংক্রামক?
কিছু কিছু শারীরিক অবস্থায় এই রোগ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমন-
- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকজনিত সংক্রমণ (ইনফেকশন), টনসিলাইটিস বা মুখগহ্বরের সংক্রমণ।
- ত্বকে আঘাত, কাটা-ছেঁড়া, রোদে পোড়া ইত্যাদি।
- কিছু কিছু ওষুধ, যেমন- উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, ম্যালেরিয়ার ওষুধ, লিথিয়াম, কর্টিকোস্টেরোইড ইত্যাদি।
- ধূমপান ও মদ্যপান।
- শারীরিক ও মানসিক আঘাত-অসুস্থতা ইত্যাদি।
- ট্যাটু বা ভ্যাকসিনের কারণেও সোরিয়াসিস বাড়তে পারে।
এসব পরিস্থিতিতে সোরিয়াসিস পুরো শরীরে ছড়িয়ে ইরাইথ্রোডার্মার মতো মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
সোরিয়াসিস রোগের চিকিৎসা
সোরিয়াসিস এমন একটি রোগ, যা পুরোপুরি সেরে যায় না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। সোরিয়াসিসের চিকিৎসা তীব্রতা অনুযায়ী জীবনভর করে যেতে হয়। নয়তো এ থেকে নানা জটিলতা তৈরি হয়। আক্রান্ত স্থানের ওপর বিভিন্ন ধরনের মলম ও ক্রিম লাগাতে বলা হয়। মুখে খাবার কিছু ওষুধ এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। অবশ্যই এসব ওষুধ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে খেতে হবে। সোরিয়াসিস শীতকালে বেড়ে যায়।
আর যাতে না বাড়ে সে জন্য বেশি গোসল, সাবান থেকে বিরত থাকতে হবে। তৈলাক্ত জিনিস ঘন ঘন ব্যবহার করতে পারেন। নারকেল তেল, অলিভ অয়েল বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো ব্যবহার করলে এই রোগ খুব একটা বাড়বে না। তা ছাড়া আলট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়েও চিকিৎসা করা হয়। রোগী প্রায়ই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন পড়ে।
কোন খাবার সোরিয়াসিস বাড়ায়
কিছু কিছু খাবার সোরিয়াসিস রোগের সংক্রমণ বাড়াতে পারে। যেমন- লাল মাংস, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, রিফাইন্ড সুগার ইত্যাদি। এসব খাদ্য গ্রহনে একটু হিসেব করে চললেই সংক্রমণ এর মাত্রা কমানো সম্ভব। মদ্যপানের কারণেও সোরিয়াসিস বাড়তে পারে। সেদিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি।
সোরিয়াসিস ও আরথ্রাইটিস রোগের সম্পর্ক
সোরিয়াসিস আক্রান্ত রুগীদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশের সোরিয়াটিক আরথ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের আরথ্রাইটিস এ আক্রান্ত হলে জয়েন্ট ফুলে যাওয়া, ব্যথা এবং ইনফ্লেমেশন দেখা দিতে পারে। যাকে অনেক সময় বাত বা গেটে বাত বলে ভুল হয়। কিন্তু ব্যথার সাথে সাথে চামড়ার লালচেভাব বা মাছের আঁশের মত ভাব থেকে সোরিয়াটিক আরথ্রাইটিসকে সাধারন আরথ্রাইটিস থেকে আলাদা করা যায়। সোরিয়াসিস এর মতই সোরিয়াটিক আরথ্রাইটিস এর লক্ষণ বাড়ে বাড়ে দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সাধারণত হাত বা পায়ের আঙ্গুল এর জয়েন্ট বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। নতুন ধরনের রিউমেটিক ডিজিজ এর ঔষধ বা ডিজিজ মোডিফাইং এন্টি রিউমেটিক ড্রাগ ( DMARD) দিয়ে এর চিকিৎসা করা হয়। তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে।
সোরিয়াসিস রোগের ক্ষেত্রে সতর্কতা
সোরিয়াসিস স্পর্শের মাধ্যমে বা একত্র বসবাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। এটি ছোঁয়াচে রোগ নয়। তবে পরিবারে সোরিয়াসিসের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি থাকে। সরাসরি সূর্যালোক ও শুষ্ক ত্বক সোরিয়াসিস রোগীর জন্য ক্ষতিকর। তাই সরাসরি রোদে অনেকক্ষণ থাকা যাবে না। ত্বক আদ্র রাখতে হবে। রোগ যত পুরোনো হয়, ততই জটিল হতে থাকে। তাই দ্রুত শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার আওতায় আসা জরুরি। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আজীবন চিকিৎসা নিতে হয়। তাই নির্দিষ্ট সময় নিয়মিত চেকআপ এবং ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে এ থেকে পরবর্তিতে ত্বকের ক্যান্সার দেখা দিতে পারে।
আশা করি এই পোস্টটি অনেক উপকারে আসবে। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; পিন্টারেস্ট.কম; টুইটার.কম