তেল। কথাটা শুলনেই মনে হচ্ছে না স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একটি জিনিস? বিরিয়ানি, ভাজা পোড়া আর গরুর রেজালার তেলটা আমরা সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই। কিন্তু সব তেল কি খারাপ? এমন কিছু তেল আছে যা মানুষের জীবন রক্ষায় পর্যন্ত কাজ করে। আর অতি প্রাচীনকাল থেকে রূপচর্চায় তেলের ব্যবহার হয়েই আসছে । এমনকি আজকাল সব টয়লেট্রিজ পণ্যে তেল একটি অতি আবশ্যক উপাদান। এমন কি মনকে প্রফুল্ল করতেও তেলের জুড়ি নেই। এসব তেল খুব সহজেই ত্বকের সাথে মিশে গিয়ে শরীরের উপকার করে। ত্বকের দ্যুতি বাড়িয়ে দেয়। আবার কিছু কিছু তেল আপনার মাথা ব্যাথা, হাঁটু ব্যাথা, গিটে ব্যথা ও সারিয়ে তুলে। তাহলে চলুন স্বাস্থ্য ও ত্বকের সুরক্ষায় নানা তেলের নানা গুণের কথা জানব আজ।
নারিকেল তেল
আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে এই তেলের গুনাগুণের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। শুধু চুলের যত্নেই না এটি ব্যবহারে আপনার ত্বক ছড়াবে অসামান্য দ্যুতি। এছাড়া ঘরের টুকটাক সমস্যা সমাধানেও নারিকেল তেল খুব কার্যকরী। মেকাপ ক্লিনজার হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এই তেল। নিয়মিত ঠোঁটে লাগালে আপনার ঠোঁট পাবে গোলাপি আভা। নারিকেল তেল ত্বকের দাগ হালকা করে বয়সের ছাপ দূর করতেও ভীষণ কাজের। আর নিষ্প্রাণ রুক্ষ চুলের আদ্রতা ফিরে পেতে নারিকেল তেলের ব্যবহার তো যুগ যুগ আগের। আবার অনেকেই মনে করেন হার্ট ভালো রাখতে ও ওজন কমাতেও নারিকেল তেল খুব উপকারি। নারকেল তেলে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম, যা হাড় ভালো রাখে। মধ্য বয়সে অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি দাতের ক্ষয়ও রোধ করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। পৃথিবীজুড়ে ম্যাসাজ থেরাপিস্টদের কাছে এই তেল ভীষণ জনপ্রিয়।
[picture]
অলিভ অয়েল
বেশ কয়েকবছর ধরে বিশ্বে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের গ্রহণযোগ্যতা বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। অথচ সেই গ্রিক সভ্যতার প্রারম্ভিককাল থেকে এই তেল ব্যবহার হয়ে আসছে, রন্ধন কর্মে ও চিকিৎসা শাস্ত্রে। চুল, ত্বক, খাবার, ঔষধ, শিশুর যত্নে, সবকাজেই একতরফা ব্যবহার করা যায় অলিভ অয়েল। ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে অলিভ ওয়েলের থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। যারা খুব ওজন নিয়ে সচেতন তারা খাবারের সাথে অলিভ অয়েল ব্যবহার করলে ফলাফল খুব তাড়াতাড়ি পাবেন। কানের ময়লা দূর করতে ঐতিহ্যগতভাবেই অলিভওয়েল ব্যবহার হয়ে আসছে। কোলেস্টরেল এর সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের জন্য উপকারি এই তেল। খুশকি আর চুলকানির সমস্যায় এই তেল ব্যবহারে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
বাদাম তেল
ভিটামিন ই তে ভরপুর তেল হল বাদাম তেল। এই তেলে ওমেগা-৯ ফ্যাটি অ্যাসিড, এসেনশিয়াল ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণই বেশি। চুলের বৃদ্ধি আর নতুন চুল গজিয়ে চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বাদাম তেল যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ। এখন প্রায় সব ময়েশ্চারাইজিং ক্রিমেই এর উপস্থিতি থাকে। চেহারা ঝলমলে ও লাবণ্যময় করতে বাদাম তেল বিশেষভাবে পরিচিত। এটি চোখের নিচের ফোলা ও কালো ভাব দূর করে। নিয়মিত বাদাম তেল মাখলে ত্বকের কালো দাগ দূর হয়। পুষ্টি ও শক্তি এ দুটো একসঙ্গে পেতে বেছে নিতে পারেন আমন্ড বা বাদাম তেল। ভিটামিন ও মিনারেলের সমৃদ্ধ এই তেল হজম ভালো করে ও পেট ভালো রাখে। বাদাম তেল প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। পৃথিবীজুড়ে ম্যাসাজ থেরাপিস্টদের কাছে এই তেল ভীষণ জনপ্রিয়।
এপ্রিকট অয়েল
পুষ্টিগুণে ভরপুর এই তেলে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-বি২, ভিটামিন-বি৩, ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-সি। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে । যাদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় তাদের জন্য এই তেল খাওয়া ভালো। এছাড়া এই তেল ময়েশ্চারাইজার ও ত্বকের পুষ্টির জন্য খুবই উপকারি।
তিলের তেল
তিলের তেল বা সিসেমি অয়েল চুলের স্বাস্থ্যের জন্য অনেকটা টনিক হিসেবে কাজ করে। তিলের তেলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই ও বি, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস ও প্রোটিন থাকে। যা চুল সুস্থ রাখতে খুবই দরকারি। মাথার ত্বকের যেকোন ইনফেকশন বা জ্বালাপোড়া দূর করে। চুল পড়া কমাতে ভালো কাজ করে। খুশকি দূর করে প্রাকৃতিক কন্ডিশনিং করে চুলকে। রাতে তিলের তেল মেসেজ করে ঘুমালে ত্বকে বলিরেখা পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তিলের তেলের মাধ্যমে দুর্বল দাঁত মজবুত করা যায়। এছাড়াও এই তেলটি, মন ভালো ও প্রাণবন্ত রাখে, মাথা ব্যথা দূর করে, অকালে চুল পাকা রোধ করে, বুদ্ধি বৃদ্ধিতে সহায়ক। অনেকের মতে গায়ের রঙ উজ্জ্বল করতেও এর ভূমিকা অপরিসীম।
ক্যাস্টর অয়েল
ক্যাস্টর অয়েল বা রেড়ির তেল এখন খুব জনপ্রিয় চুলের যত্নে। চিকিৎসকদের মতে কারও জেনেটিকাল বা হরমনাল সমস্যা না থাকলে এই তেল দিয়ে অবশ্যই চুল গজাবে। চুল কিংবা আপনার ত্বক যেকোনো জায়গায় এর ব্যবহার অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান হিসেবে কাজ করে। চুল পড়ে যাওয়া ও রুক্ষ হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া রোধ করে। ক্যাস্টর অয়েল চুলে ভেতর থেকে পুষ্টি জুগিয়ে আগা ফাটা ও রোধ করে। এতে আছে প্রোটিন এবং ফ্যাটি অ্যাসিড যা পাপড়ি এবং ভ্রু ঘন করে।
নিমের তেল
ব্রণের জন্য অভিশাপ স্বরূপ হল এই নিমের তেল। এটি ব্রণের ব্যাক্টেরিয়া দূর করে। নিম তেলের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বকে সহজে বার্ধক্যের ছাপ পড়তে দেয় না। নিম তেল ফ্যাটি এসিডে সমৃদ্ধ যার ফলে তেলটি সহজে ত্বকের সাথে মিশে যায়। নিয়মিত নিম তেল ব্যবহার করলে ত্বকের বলিরেখা ও বার্ধক্যজনিত যাবতীয় দাগ দূর করা সম্ভব। ত্বকের লাল ভাব ও ব্রণের ক্ষত থেকে ব্যথা হলে নিমের তেলটা সারিয়ে তোলে। এটি একটি উন্নত মানের অ্যান্টিসেপ্টিক। পোকার কামড়ে নিম তেল ব্যবহার করলে জ্বালাপোড়ার উপশম হয়।
তিসির তেল
এই তেলে থাকে প্রচুর পরিমাণ ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালোরি, শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট, খাদ্য আঁশ, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন। এটি চুল ও ত্বককে সুস্থ্য ও উজ্জ্বল রাখে। কোমল ত্বকের জন্য অনবদ্য নাম তিসির তেল। ওজন কমাতে সাহায্য করে। মেধা বিকাশের জন্য কার্যকরী।
অ্যাভোক্যাডো অয়েল
অ্যাভোক্যাডো ফল ত্বকের প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে বিশ্বে সবার কাছে সমাদৃত। এই ফল থেকে পরিশোধিত উপায়ে বের করা হয় তেল। এই তেল ত্বকের শীতল ও মসৃণভাব ধরে রাখে। ত্বকের নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে। নিয়মিত খেলে ভেতর থেকে ত্বক ও চুল থাকবে সজীব।
হ্যাজেলনাট অয়েল
ব্রণ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হ্যাজেলনাট অয়েলের ভুমিকা অনেক। এটি খুব সুন্দর করে ত্বকের উপরিভাগের ময়লা ও মৃতকোষ দূর করে। ত্বকে তেলের অতিরিক্ত তেলের নিঃসরণ বন্ধ করে অন্তর্নিহিত আর্দ্রতা ধরে রাখতেও কাজ করে।
টি ট্রি অয়েল
ব্রণ ও ব্রণের দাগ দূর করতে টি ট্রি অয়েল বিশেষ উপযোগী। এটি এক প্রকারের অ্যান্টিসেপ্টিক। তাই যেকোন ধরণের ফাঙ্গাস আক্রমণ থেকে বাঁচায়। শরীরের র্যাশ ও গরমের কারণে ইচিং থেকেও মুক্তি দেয় এই তেল। চুলের যত্নে এই তেল ব্যবহারে খুশকি ও মাথার ত্বকের অন্যান্য সমস্যা দূর হয়।
নিজের পছন্দ মতো, সুবিধা অনুযায়ী আপনার পছন্দের তেলটি বেছে নিন। তারুণ্য ধরে রেখে দীর্ঘদিন থাকুন একদম ঝলমলে চেহারা এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।
ছবি – কেয়ার টু ডট কম, পিন্টারেস্ট ডট কম, কুক দ্যা স্টোন ডট কম
লিখেছেন – নাজমুন নাহার তুলি