একটি পরিবারের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত হচ্ছে, যখন সেই পরিবারে একজন নতুন অতিথির আগমন ঘটে। নবজাতকের জন্ম বাবা-মা সহ পরিবারের সবার জীবনে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। কিন্তু জন্মের পরপরই যদি শিশুটি অসুস্হ হয়ে পড়ে, কিংবা স্বল্প ওজন ও প্রিম্যাচিউরিটির কারণে যদি দেখা দেয় শারীরিক জটিলতা, তখন এই শিশুটিকে নিয়ে গোটা পরিবারের দুশ্চিন্তার যেন শেষ থাকে না। এমন পরিস্থিতির সাথে কম বেশি আমরা অনেকেই পরিচিত, তাই এই বিষয়ে আপনাদের আরও একটু সচেতন করতে আজ আমি আলোচনা করবো প্রিম্যাচিউর বেবি বার্থ ও এর জটিলতাসমূহ নিয়ে। চলুন একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
প্রিম্যাচিউর বেবি বার্থ কখন বলা হয়?
৩৭-৪২ সপ্তাহের গর্ভকালীন সময়কে বলা হয় টার্ম প্রেগনেন্সি। ৩৭ সপ্তাহের পূর্বে বাচ্চা জন্ম নিলে একে বলা হয় প্রিটার্ম বার্থ বা প্রিম্যাচিউর বার্থ। তেমনি ৪২ সপ্তাহের পর যদি কোন বাচ্চার জন্ম হয়ে একে বলা হয় পোস্ট টার্ম প্রেগনেন্সি। জেনে রাখা ভালো, ৪০ সপ্তাহ গর্ভকালীন সময় হিসেব করে এক্সপেক্টেড ডেট অব ডেলিভারি বা ইডিডি নির্ধারণ করা হয়। তাই বলে সব বাচ্চা যে এই ৪০ সপ্তাহেই ভূমিষ্ঠ হবে এমন নয়, অনেকক্ষেত্রে ইডিডি এর এক সপ্তাহ আগে থেকে এক সপ্তাহ পরে নবজাতকের ভূমিষ্ঠ হবার ঘটনা ঘটতে পারে। লক্ষণ ও জটিলতায় ওভারল্যাপিং থাকায় ‘প্রিটার্ম’ ও ‘প্রিম্যাচিউরিটি’ শব্দদুটো সমার্থক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে সমগ্র লেখা জুড়ে।
প্রিম্যাচিউরিটি ঝুঁকিপূর্ণ কেন?
বি ডি এইচ এস এর এক সার্ভেতে দেখা যায় বাংলাদেশে ০-২৮ দিন বয়সী শিশুমৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে প্রিটার্ম বার্থ একটি বড় ফ্যাক্টর। প্রায় ৪৫% নবজাতকের মৃত্যুর জন্য দায়ী প্রিটার্ম বার্থ ও এর কমপ্লিকেশনস। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫ মিলিয়ন বাচ্চা ৩৭ সপ্তাহের পূর্বে জন্ম নিচ্ছে। এতে শিশুমৃত্যুর হার যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমন হাসপাতাল ব্যয় ও চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
লক্ষণগুলো কী?
গর্ভকালীন বয়সঃ ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া বাচ্চাগুলো সাধারণত প্রিম্যাচিউর হয়। প্রিটার্ম বাচ্চাদের তিনটি সাব-ক্লাসে ভাগ করা হয়।
- মডারেট টু লেট প্রি-টার্মঃ ৩২-৩৭ সপ্তাহে জন্মগ্রহণকারী নবজাতক
- ভেরি প্রি-টার্মঃ ২৮-৩২ সপ্তাহে জন্মগ্রহণকারী নবজাতক
- এক্সট্রিমলি প্রি-টার্মঃ ২৮সপ্তাহের পূর্বে জন্মগ্রহণকারী নবজাতক
এই ধরনের বেবিদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য
ওজন: ২৫০০ গ্রাম এর কম হয় সাধারণত।
দৈর্ঘ্য: স্বাভাবিক একটি বাচ্চা জন্মের সময় গড়ে ৫০ সে.মি দৈর্ঘ্যের হয়, প্রিটার্ম নবজাতক এর চেয়ে কম হতে পারে।
চামড়ার রং: প্রিম্যাচিউর বাচ্চাদের ফুসফুস পরিণত না হওয়ায় এদের রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা যায়, যার ফলে নবজাতকের চামড়ার রং নীলচে রংয়ের হয়ে থাকে। পরবর্তীতে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চালু হলে ধীরে ধীরে বাচ্চা গোলাপি রং এ পরিবর্তিত হয়।
শ্বাস-প্রশ্বাস: একটি সুস্থ নবজাতক প্রতি মিনিটে প্রায় ৫০-৬০ বার শ্বাস গ্রহণ করে। নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুরা অক্সিজেন স্বল্পতায় প্রতি মিনিটে ৬০ বারের বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে। অন্যদিকে নিওনেটাল সেপসিসে বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাস একেবারে কমে যায়, প্রয়োজনভেদে শিশুর সি পি আর বা কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস এর ব্যবস্থা লাগতে পারে।
হৃৎস্পন্দন: স্বাভাবিক নবজাতকের হৃৎস্পন্দন গড়ে প্রতি মিনিটে ১০০-১৬০ বার। প্রিম্যাচিউরদের হৃৎস্পন্দন ক্ষেত্রভেদে কম বেশি হয় যা কিনা একটি বিপদ সংকেত।
হাইপোথার্মিয়া: তাপমাত্রা প্রিম্যাচিউর বাচ্চারা প্রায়শই হাইপোথার্মিয়াতে ভোগে। তাই জন্মের পর পর বাচ্চাকে ওয়ার্ম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইউরিন আউটপুট: জন্মের ২৪ ঘন্টার মধ্যে নবজাতক প্রস্রাব করার কথা, এর ব্যতিক্রম হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ফিডিং এর সমস্যা: সাকিং রিফ্লেক্স যথার্থ না হওয়ায় প্রিম্যাচিউর নবজাতক বুকের দুধ প্রোপারলি টেনে খেতে পারে না।
প্রিম্যাচিউর বেবি বার্থ এর কারণ
১/ বাল্য-বিয়ে ও কম বয়সে মা হওয়া।
২/ মায়ের স্বাস্থ্যহীনতা।
৩/ মায়ের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ।
৪/ গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ ও রক্ত স্বল্পতা।
৫/ গর্ভাবস্থায় মা ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন, হাম, রুবেলা, টক্সোপ্লাজমা কিংবা সাইটোমেগালো ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে অ্যাবোরশন, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চা জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
৬/ টুইন বা মাল্টিপল প্রেগনেন্সির কারণে আগে আগেই ডেলিভারি পেইন উঠতে পারে।
৭/ যেসব বাচ্চা পেটে থাকতেই জন্মগত ত্রুটিতে ভোগে তাদের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮/ মা যদি গর্ভাবস্থায় ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখেন, সহজেই সংক্রমিত হন যা কিনা প্রিম্যাচিউর লেবারের দিকে ঠেলে দেয়।
সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া বেবির কম্পলিকেশনস
- জন্মের পর বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা কমে যায় যাকে হাইপোথার্মিয়া বলা হয়
- জন্মের পর ব্লাড গ্লুকোজ কমে যাওয়া, বিশেষ করে মা ডায়াবেটিক হলে বাচ্চার ক্ষেত্রে এমন সমস্যা বেশি ঘটে
- ফুসফুস অপরিণত থাকে অনেক ক্ষেত্রেই
- বাচ্চার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কম থাকায় শ্বাসকষ্ট ডেভেলপ করতে পারে
- বাচ্চা জন্মের প্রক্রিয়ায় বা জন্মের পর স্পর্শ কিংবা ফিডিং প্রসিডিওর স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় নিওনেটাল সেপসিস হতে পারে
- জন্ডিস, ডায়ারিয়া, রক্তশূন্যতা এই ধরনের সমস্যা হতে পারে
- সেরেব্রাল পালসি বা সিপি হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে
প্রিম্যাচিউর বাচ্চার যত্ন
১) অবশ্যই হাসপাতালে ডেলিভারি নিশ্চিত করা। হাসপাতালে বাচ্চাদের জন্য আই সি ইউ আছে কিনা সেটাও জেনে নিন।
২) জন্মের পর পর বাচ্চাকে ওয়ার্ম রাখা, যতটা সম্ভব মায়ের সংস্পর্শে রাখা।
৩) জন্মের পর যত দ্রুত সম্ভব মায়ের বুকের দুধ পান করানো এবং ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ দেওয়া, এমনকি এক ফোঁটা পানিও দেওয়া উচিত নয়।
৪) ইনফেকশন এড়িয়ে চলার জন্য বাচ্চাকে হ্যান্ডলিং করার আগে হাত পরিষ্কার করে নিন। অর্থাৎ হাইজিন মেনটেইন করুন।
৫) ডায়াবেটিক মায়ের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই জন্মের পরপর ব্লাড গ্লুকোজ চেক করতে হবে এবং অন্যান্য ব্যবস্থার জন্য ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।
সবশেষে বাচ্চা ও মা বাসায় অবস্থান করলে খেয়াল রাখুন বাচ্চা ঠিকমতো বুকের দুধ খেতে পারছে কিনা কিংবা বাচ্চা একদম ঝিমিয়ে পড়েছে কিনা! জ্বর, খিঁচুনি, পেট ফুলে যাওয়া বা শ্বাসকষ্ট ডেভেলপ করলে আর দেরি না করে চলে যান নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। প্রিম্যাচিউর বেবি বার্থ নিয়ে জরুরি তথ্য আজ আমরা জানতে পারলাম। আজ এখানেই ইতি টানছি, লিখবো অন্যদিন ভিন্ন কোনো বিষয়ে। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন।
ছবি- সাটারস্টক