ত্বকের অ্যালার্জি সম্পর্কে সঠিক ধারণা কিন্তু আমাদের অনেকেরই নেই। অনেক কারণে অ্যালার্জি হয়ে থাকে। তাই অ্যালার্জি সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। তারপর তার প্রতিকার করা উচিত। চলুন জেনে নেওয়া যাক এর কারণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত।
ত্বকের অ্যালার্জি হওয়ার কারণ
১. অ্যালার্জিক বিক্রিয়া
ফুলের পরাগ, দূষিত বাতাস, ধোঁয়া, কাঁচা রঙের গন্ধ, চুনকাম, ঘরের ধুলো, পুরনো ফাইলের ধুলো দেহে অ্যালার্জিক বিক্রিয়া করে।
২. দুধে অ্যালার্জি
খাদ্যে প্রচুর অ্যালার্জির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে গরুর দুধে খুবই বেশি অ্যালার্জি হতে দেখা যায়। গরুর দুধে বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে গায়ে চুলকানি হতে দেখা যায়। এছাড়া গম, ডিম, মাছে অ্যালার্জি হতে দেখা যায়। বাদাম, কলা, আপেল, আঙ্গুর, ব্যাঙের ছাতা, পেঁয়াজ, রসুন, চকোলেট, এমনকি ঠাণ্ডা পানীয় কোনো কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে অ্যালার্জি সৃষ্টি করে।
৩. ঘাম ও ঘরের ধুলো
গরমে ঘাম হলে এবং ঘরের ধুলো অ্যালার্জির জন্য একটি অন্যতম কারণ। সে জন্য যারা অ্যালার্জিক সমস্যায় ভোগেন তারা ঘরের ধুলো সব সময় এড়িয়ে চলবেন। বিশেষ করে যখন ঘর ঝাড়ু দেবেন তখন সেখান থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। ঘরের আসবাবপত্র যেমন কম্বল, পর্দা, তোষক, বালিশ প্রভৃতিতে যে ধুলো জমে থাকে তা পরিষ্কার করার সময় দূরে সরে থাকতে হবে।
৪. ছত্রাক
নোংরা, ভেজা পদার্থে ছত্রাক জন্মাতে দেখা যায়। আবার কোনো কোনো খাদ্য যেমন পনির, কেক, পাউরুটি, আলু ও পেঁয়াজ ছত্রাক দ্বারা দূষিত হয়ে থাকে। এই ছত্রাক অ্যালার্জি সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ।
৫. কিট পতঙ্গের কামড়ে
মশা, বেলেমাছি, মৌমাছি, বোলতা, ভীমরুল প্রভৃতি কিট পতঙ্গের কামড়ে দেহে অ্যালার্জির সৃষ্টি হয়।
৬. গৃহপালিত পশু থেকে
রোমশ, পালক বিশিষ্ট জীবজন্তু যেমন বিড়াল, কুকুর, অশ্ব প্রভৃতি গৃহপালিত পশু অনেক সময় অ্যালার্জি সৃষ্টির জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
৭. আর্টিকেরিয়া
এক ধরনের চর্মরোগ আছে যাকে বলা হয় আর্টিকেরিয়া (urticaria)। এ ক্ষেত্রে ত্বক চাকা চাকা হয় আর ফুলে উঠে চুলকাতে দেখা যায়। এটিও ত্বকের অ্যালার্জির অন্যতম প্রকাশ। বেশির ভাগ লোকের জীবনেই কোনো না কোনো সময় এই রোগ হতে দেখা যায়। এই আর্টিকেরিয়া শরীরের কোনো অংশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে অথবা সমস্ত শরীর ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে বিভিন্ন আকারের লালচে চাকা চাকা ফোলা দাগ হতে দেখা যায় এবং সেই সাথে থাকে প্রচণ্ড চুলকানি। খাদ্য অ্যালার্জি থেকেও এ রোগ হতে পারে যেমন বাদাম, ডাল, গোশত, ডিম ইত্যাদি।
৮. ওষুধে অ্যালার্জি
ওষুধে অ্যালার্জি হতে পারে। অনেক ওষুধই অ্যালার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী। এর মধ্যে পেনিসিলিন (Penicillin) আর এসপিরিন (Aspirin) অন্যতম। জ্বর, গায়ে ব্যথা, মাথা ব্যথা, পাঁচড়া, ফোঁড়া ইত্যাদির জন্য এই ওষুধ দুটো আমরা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন (Prescription) ছাড়াই খেয়ে থাকি। কিন্তু মনে রাখতে হবে এর থেকে গায়ে অ্যালার্জি জনিত চুলকানি হতে পারে। এমন কি পেনিসিলি ব্যবহারের কারণে মৃত্যু পর্যন্তও হতে পারে।
এছাড়া আরো অসংখ্য ওষুধ আছে যা খেয়ে গায়ে অ্যালার্জির সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ কখনোই খাওয়া উচিত নয়।
৯. টিকা বা ভ্যাকসিন থেকে
আমরা শিশুদের টিকা দিয়ে থাকি। কোনো কোনো টিকা বা ভ্যাকসিনে ব্যক্তি বিশেষে অ্যালার্জি হতে দেখা যায়। সুতরাং ভ্যাকসিন দেয়ার পর আপনার শিশুকে যদি অ্যালার্জি চুলকানি জনিত সমস্যায় ভুগতে দেখা যায় তাহলে অবশ্যই আপনার শিশুকে ডাক্তারের কাছে নেয়া উচিত।
১০. অতিরিক্ত মেকআপ
অতিরিক্ত মেকআপ ব্যবহার করলে অ্যালার্জি হয়ে থাকে।
ত্বকের অ্যালার্জি থেকে রক্ষা পেতে করণীয়
১. ত্বক পরিষ্কার
সবচেয়ে বেশি জরুরী ত্বক পরিষ্কার রাখা। দিনে যতবার সম্ভব মুখে পানির ঝাপটা দিন। কোন কৃত্রিম প্রসাধনী ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করুন।
২. বেসন ও শসার রস মিশ্রিত পেস্ট
বেসনে শসার রস মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ পর তা ধুয়ে ফেলুন।
৩. ময়দা ও গোলাপজল এর মিশ্রণ
ময়দা ও গোলাপজল এর মিশ্রণ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে পারেন।
৪. লবঙ্গ ও মেথি
লবঙ্গ ও মেথি একসাথে পিষে মিশ্রণটি ব্রণের উপর লাগিয়ে রাখুন। যাদের মুখ তৈলাক্ত তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
৫. ত্বকে বরফ ব্যবহার
বাইরে বের হওয়ার আগে ১০ মিনিট ত্বকে বরফ ঘষুণ।
৬. পাতিলেবুর রস
পাতিলেবুর রস তুলায় ভিজিয়ে ত্বকে দুইবার লাগাতে পারেন। অতিরিক্ত ঘাম ত্বকের আর্দ্রতা কমিয়ে ফেলে। ফলে লোমকূপের গোড়ায় বাসা বাঁধে রোগ জীবাণু। ঘাম বেশি হলে তাড়াতাড়ি মুছে ফেলার চেষ্টা করুন।
৭. নিয়মিত গোসল
নিয়মিত গোসল করুন, প্রচুর পানি পান করুন এবং সানক্রিম ব্যবহার করুন। নিয়মিত ডিওডোরেন্ট ও বডি স্প্রে ব্যবহার করুন।
৮. নিমপাতার রস
যাদের ত্বকে নিয়মিত ঘামাচি হয় তারা নিমপাতার রস লাগালে উপকার পাবেন।
৯. অতিরিক্ত মেকআপ থেকে বিরত থাকা
যেহেতু অতিরিক্ত মেকআপ থেকে অ্যালার্জি হয়ে থাকে তাই মেকআপ সঠিকভাবে উঠানও জরুরি। যাদের ত্বকে ব্রণের সমস্যা আছে মেকআপ তোলার জন্য তারা খুবই নমনীয় ক্লিনজার ব্যবহার করবেন। চোখের মেকআপ উঠানোর ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি ঘষাঘষি না করা হয়। মেকআপ উঠানোর পর ত্বক ভালোভাবে পরিষ্কার করে ত্বকের নমনীয়তা বজায় রাখতে ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে।
৯. লেবুর রস ও গ্রিন টি
এক মগ পানিতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে পান করে দিনটা শুরু করুন। এটি অ্যন্টি-অক্সিডেন্ট (Anti-Oxidant) হিসেবে কাজ করবে। আর সকালে কফির বদলে গ্রিন টি পানেও ত্বক সুন্দর থাকবে।
১১. খাদ্য তালিকায় সবজি ও ফলমূল
প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সবজি ও ফলমূল রাখতে হবে।
অ্যালার্জি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। অ্যালার্জির অনেক আধুনিক ওষুধপত্র আজকাল আছে যার মাধ্যমে খুব অল্প সময়েই অ্যালার্জির কষ্ট ও চুলকানি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। চিকিৎসক এর উপদেশ ও ওষুধপত্রের মাধ্যমে যেকোন অ্যালার্জির রোগী সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন অনায়াসেই। মনে রাখতে হবে, অ্যালার্জি হঠাৎ করে যেকোন মানুষের, যেকোন সময়, যেকোন বয়সে, বছরের যেকোন সময় হতে পারে। মোট কথা যে কারণে আপনার অ্যালার্জি হয় সেই কারণ এড়িয়ে চলতে হবে এবং অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
ছবি – সংগৃহীত: সাটারস্টক