আমরা সবাই থ্যালাসেমিয়া নামটি শুনেছি কিন্তু হয়তো খুব কম মানুষই আছি যারা এর সাথে সম্পূর্ণভাবে পরিচিত। থ্যালাসেমিয়া হলো রক্তের এক ধরনের অসুস্থতা যা বংশগতভাবে আমাদের আক্রমণ করে। থ্যালাসেমিয়ার কারণে আমাদের শরীর সামান্য কিছু স্বাস্থ্যকর লাল রক্ত কণিকা উৎপন্ন করে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম পরিমাণ হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। হিমোগ্লোবিন হল লাল লোহিত কনিকায় নিহিত এক ধরনের প্রোটিন যা অক্সিজেন বহন করে। হিমোগ্লবিন লাল লোহিত কনিকার খুব প্রয়োজনীয় উপাদান। প্রত্যেক মানুষই হয় নরমাল না হয় থ্যালাসেমিয়া মেজর অথবা থ্যালাসেমিয়া মাইনরের অধিকারী হয়ে থাকেন। থ্যালাসেমিয়া মেজর তখন হয় যখন শিশু বাবা-মা ২ জনের কাছ থেকে ১টি করে মিউটেটেড জিনের (Mutated Gene) অধিকারী হয়। এসব শিশুরা স্বাভাবিক, পরিণত হিমোগ্লোবিন (Hemoglobin) তৈরিতে অক্ষম থাকে। থ্যালাসেমিয়া ট্রেইটকে (Thalassemia trait) মাঝে মাঝে থ্যালাসেমিয়া মাইনর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরা বাবা-মা যেকোনো ১ জনের কাছ থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিন গ্রহন করে। থ্যালাসেমিয়া মাইনর, থ্যালাসেমিয়া মেজর থেকে অনেকটা নিরাপদ। থ্যালাসেমিয়ার কারণে অ্যানিমিয়া (Anemia) দেখা দিতে পারে।
থ্যালাসেমিয়ার যত কথা
থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কারণ
হিমোগ্লোবিন ২ ধরনের প্রোটিন দ্বারা তৈরি – আলফা গ্লোবিন ও বিটা গ্লোবিন। থ্যালাসেমিয়া তখনই হয় যখন এই ২টি প্রোটিন উৎপন্নে সাহায্যকারী জিনে কোন ত্রুটি দেখা দেয়।
থ্যালাসেমিয়া আবার ২ প্রকারের। একটি হচ্ছে আলফা থ্যালাসেমিয়া ও অন্যটি হচ্ছে বিটা থ্যালাসেমিয়া।
১. আলফা থ্যালাসেমিয়া তখন দেখা দেয় যখন আলফা গ্লোবিন প্রোটিনের (Alpha Globin Protein) সাথে সম্পর্কিত জিন পরিবর্তিত থাকে অথবা অনুপস্থিত থাকে।
২. আর যখন ত্রুটিপূর্ণ জিনগুলো বেটা গ্লোবিন প্রোটিন (Beta Globin Protein) উৎপন্নে বাঁধা দেয় তখন বেটা থ্যালাসেমিয়া হয়।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
সাধারণত থ্যালাসেমিয়ার ধরণ আর তিব্রতার উপর লক্ষণ নির্ভর করে। কিছু কিছু শিশু জন্মগত ভাবেই থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ নিয়ে জন্মায়। আবার কেউ তার জন্মের ২ বছরের মধ্যে লক্ষণ দেখানো শুরু করে।
১. অল্পতেই শরীর অবসন্ন হয়ে যাওয়া।
২. দুর্বলতা অনুভব করা।
৩. চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া।
৪. মুখের হাড়ে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।
৫. ইউরিনের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া (লাল লোহিত কনিকা ভেঙ্গে যাওয়ার লক্ষণ) ও চোখের রঙ হলদে হয়ে যাওয়া।
৬. খাওয়াতে অরুচি দেখা দেয়।
থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার কারণে শারীরিক অন্যান্য জটিলতা
বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে আর সেই সাথে মাঝারি থেকে প্রকট ধরনের থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসাও বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সব কিছুরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যে আছে তা মেনে নিতেই হবে।
১. হার্ট এবং লিভারের অসুখ
নিয়মিত ব্লাড ট্রান্সফিউশন (Transfusion) থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার একটি প্রধান উপায়। ফলে রক্তে আয়রন ওভারলোড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে অর্গান এবং টিস্যুর ক্ষতি হয়ে থাকে। বিশেষ করে হার্ট ও লিভার। হার্টের অসুখের মধ্যে অন্যতম হলো হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিওর (Heart failure), আর্থিমিয়াস (Arrhythmias).
২. ইনফেকশন
থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের মৃত্যুর আরেকটি কারণ হল ইনফেকশন। বিশেষ করে যাদের স্প্লিন (Spleen) শরীর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ ইনফেকশনের সাথে যুদ্ধরত অঙ্গটি আর শরীরে অবস্থান করছে না।
৩. অস্টিওপোরোসিস
যেসব মানুষদের থ্যালাসেমিয়া আছে তাদের মধ্যে হাড়ের সমস্যা যেমন অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis) দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটি এমন এক সমস্যা যার ফলে শরীরের হাড় ক্ষয় হয়ে ভঙ্গুর হয়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়া ডায়াগনোসিস
ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে আপনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব। ব্লাড টেস্টের অন্তর্ভুক্ত হল কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট আর স্পেশাল হিমোগ্লোবিন টেস্ট।
যদি আপনার সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে তার ব্লাড টেস্টে নিম্ন লিখিত পরিবর্তনগুলো দেখা যাবেঃ
১. অপর্যাপ্ত লোহিত রক্ত কনিকা।
২. স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট রক্ত কনিকা।
৩. ফ্যাকাসে লাল লোহিত কনিকা।
৪. লাল লোহিত কণিকাগুলোতে আনইভেন হিমোগ্লোবিন দেখা যাবে, যার ফলে কোষটি মাইক্রোস্কপের (Microscope) নিচে দেখতে বুলস আই (bull’s-eye) এর মত লাগবে।
থ্যালাসেমিয়া জিন এবং প্রেগন্যান্সি
১. সন্তান যদি বাবা-মা ২ জনের কাছ থেকে ২টি স্বাভাবিক জিন গ্রহণ করে তাহলে স্বাভাবিক রক্তের অধিকারী হবে।
২.সন্তান যদি ২ জনের মধ্যে যে কোন ১ জনের কাছ থেকে স্বাভাবিক জিন এবং আরেকজনের কাছ থেকে ভ্যারিঅ্যান্ট (Variant) জিন গ্রহণ করে তাহলে এটি থ্যালাসেমিয়ার প্রলক্ষণ।
৩. আবার সন্তান যদি বাবা-মা ২ জনের কাছ থেকেই একটি একটি করে থ্যালাসেমিয়ার জিন গ্রহণ করে তাহলে মাঝারি থেকে প্রবল আকারের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের জন্য কিছু ঘরোয়া উপায়
আসলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে তেমন কোন ঘরোয়া উপায় নেই এটি প্রতিরোধের জন্য। কিন্তু অবস্থার যেন আরও অবনতি না ঘটে সেটার জন্য আমরা আমাদের লাইফ স্টাইলে কিছু পরিবর্তন আনতে পারি।
১. অতিরিক্ত আয়রন গ্রহন না করা
অতিরিক্ত আয়রন গ্রহন থেকে বিরত থাকা। যতদিন না ডাক্তার আপনাকে রেকমেন্ড করে ততদিন আয়রন সমৃদ্ধ ভিটামিন গ্রহণ করবেন না।
২. স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য
ব্যালেন্সেড ডায়েট যা পুষ্টিগুণে ভরপুর এমন খাদ্য খাওয়া উচিত। এতে আপনার এনার্জি লেভেল বজায় থাকবে। চিকিৎসকেরা সাধারণত ফলিক এসিড (Folic Acid) গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন, এতে আপনার শরীরে নতুন রক্ত কনিকা তৈরি হয়। এছাড়াও দেহের হাড়ের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি আর ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে।
৩. ইনফেকশন থেকে দূরে থাকুন
নিজেকে ইনফেকশন থেকে নিরাপদ রাখার জন্য সব সময় সাবান দ্বারা হাত পরিষ্কার করুন বিশেষ করে আপনার শরীর থেকে যদি স্প্লিন কেটে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে এবং জ্বর সর্দি বা ছোঁয়াচে অসুখে অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকুন। মেনিন জাইটিস (Menin Zytis) , হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন ইনফেকশন থেকে বাঁচার জন্য।
৪.গর্ভধারণের পূর্বে টেস্ট
যদি একজন মহিলা অথবা তার স্পাউসের বংশে থ্যালাসেমিয়ার হিস্ট্রি থেকে থাকে তাহলে গর্ভধারণের আগে অবশ্যই ব্লাড টেস্ট করা উচিত। রক্ত পরীক্ষা আর ফ্যামিলি জেনেটিক পর্যবেক্ষণ করে জানা যাবে ২ জনের কেউ থ্যালাসেমিয়ার শিকার অথবা ক্যারিয়ার কিনা।
৫.বিয়ের আগেই ব্লাড টেস্ট
যদিও এই পদ্ধতি আমাদের সমাজে এখনও প্রচলিত নয়, তবুও আমাদের উচিত নিজেদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বার্থে বিয়ের আগে হবু বর এবং বউয়ের রক্ত পরীক্ষা করা।
তবে আশার কথা হচ্ছে গবেষকরা থ্যালাসেমিয়া প্রতিকারের জন্য স্টাডি করে যাচ্ছেন। খুব শিগগির হয়তো ষ্টীম সেল Steam Cell) আর জিন থেরাপির (Gene Therapy) মাধ্যমে এর প্রতিকার সম্ভব হবে।
ছবি – সংগৃহীত: ইএস.স্লাইডশেয়ার.নেট, প্যাথফি.ওআরজি, লুপস্কোপ.কম, পিনটারেস্ট.কম, ১২৩আরএফ.কম, হেলথ.কোডিফি.কম, কুকিস্ট.কম, জাস্টডায়েল.কম, পিকডো.কম, থ্যালাসেমিয়া.ওআরজি.সিওাই