চুল পড়া কীভাবে বন্ধ করা যায় আর নতুন চুল কীভাবে গজানো যায় তা নিয়ে আমাদের প্রশ্নের শেষ নেই। সবাই জিজ্ঞেস করে চুল পড়া বন্ধ করতে কোন শ্যাম্পু ব্যবহার করব? কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কোন শ্যাম্পু চুল পড়া বন্ধ তো করেই না বরং এগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে চুল পরা আরও বাড়ে। আর এর জন্য দায়ী শ্যাম্পুতে থাকা সোডিয়াম লরেথ সালফেট (SLS, SLES) এবং সিলিকন। ( শ্যাম্পুর উপাদান দেখে নেবেন, একদম শুরুতেই বড় বড় করে এর নাম লেখা আছে)।
এখন যদি বলি একদম প্রাকৃতিক উপায়ে খুবই কম খরচে আপনি নিজেই সম্পূর্ণ নিরাপদ শ্যাম্পু তৈরি করতে পারবেন। যা চুল পড়া বন্ধ করার পাশাপাশি চুলকে দেবে এমন জেল্লা যাতে কন্ডিশনার ব্যবহারের প্রয়োজনও আর পড়বে না? তবে? তো দেরি না করে চলুন শুরু করি।
এই প্রাকৃতিক শ্যাম্পু তৈরি করব আমাদের দাদি,নানি দের রেসিপি ব্যবহার করে। শ্যাম্পুর যুগ এসে আমাদের মাথা খালি হয়ে যাবার আগে তারা রিঠা আর শিকাকাই দিয়েই তো চুল পরিষ্কার করতেন। সাথে ছিল বিশুদ্ধ তেল আর মেহেদি। যারা রিঠা আর শিকাকাই চেনেন না তারা দেখুন এগুলো কী আর এর উপকারিতা কী?
শিকাকাইঃ
শুকনো তেঁতুলের মত দেখতে যে ফলটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেটা। এর নামের আক্ষরিক অর্থ Fruit for hair.Acaccia Concinna অথবা শিকাকাই আমাদের উপমহাদেশে কেশ চর্চায় প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত। এর ফল আর বাঁকল থেকে শ্যাম্পু তৈরি করা হয়। এতে ফেনা হয় যা সালফেট শ্যাম্পু থেকে কম হলেও চুল পরিষ্কারে নরমাল শ্যাম্পু থেকে অনেক বেশি কাজের। পাশাপাশি এটা ন্যাচারাল কন্ডিশনারের কাজও করে।
রিঠাঃ
ছবির গোল শুকনো বরইয়ের মত দেখতে ফলটি। এর ইংরেজি নাম Soapnut (Sapindus mukorossi)। নাম থেকেই বোঝা যায় পরিষ্কারের কাজে এর জুরি মেলা ভার। আজো গ্রামে এটা দিয়ে কাথা, লেপ পর্যন্ত ধুয়ে ফেলা হয়। এতে প্রচুর ফেনা হয়। চুলের খুশকি, মাথার একজিমা আর উকুন দুর করতেও এর ব্যবহার করা হয়।
এবার দেখি এই রিঠা আর শিকাকাই দিয়ে কীভাবে শ্যাম্পু বানানো যায়।
উপাদানঃ
আমার চুল কোমর ছাড়িয়ে যায়। তাই আমি ১৫-২০ টা রিঠা আর ৫-৭ টা শিকাকাই নিই। আপনার চুল যদি বেশি রুক্ষ হয় তবে শিকাকাই এর সংখ্যা বাড়িয়ে রিঠা কমাবেন। কারণ শিকাকাই চুল মসৃণ আর নরম করে। রিঠা আর শিকাকাই দুটোই নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারে খুব কম দামে পেয়ে যাবেন। পাউডার করা হলেও কিনতে পারেন। সেক্ষেত্রে চার চামচ রিঠার সাথে দুই চামচ শিকাকাই মেশাবেন। কিন্তু ভেজালের আশঙ্কা থাকায় আমি আস্ত রিঠা, শিকাকাই কিনতেই বলব।
প্রণালীঃ
১। প্রথমে রিঠার বীজ বের করে নিয়ে শিকাকাই সহ কয়েক ঘণ্টা পানিতে ভিজান। এতে এগুল নরম হবে। (এই পদ্ধতিতে এক সপ্তাহ ধরে ব্যবহার করার মত শ্যাম্পু তৈরি হবে, তাই সময় একটু বেশি লাগলেও সমস্যা নেই।)
২। এবার একটা কড়াইতে এগুলো ডুবিয়ে পানি ঢালুন। (রিঠা, শিকাকাই ভেজান পানি সহ) আর ১৫-২০ মিনিট চুলায় অল্প আঁচে সিদ্ধ করুন।
৩। নিচের ছবিতে দেখুন, ফেনা দেখতে পাচ্ছেন? এমন ফেনা দেখা গেলে চুলা থেকে নামিয়ে নিন। এবার ঠাণ্ডা করে শ্যাম্পু হিসেবে ব্যবহার করুন। ছেঁকে নিয়ে শুধু পানিটা ব্যবহার করতে পারেন আবার আমার মত সব ফল একসাথে কঁচলে নিয়েও ব্যবহার করতে পারেন। এই পানিটা মগে পরিমাণ মত নিয়ে হাত দিয়ে জোরে ঘুটুনি দিলেই দেখবেন কতটা ফেনা পাওয়া যায়।
এই মিশ্রণটি এক সপ্তাহ ফ্রিজে রাখতে পারবেন।
কীভাবে ব্যবহার করবেন?
- পানি দিয়ে চুল ধুয়ে নিন
- এবার আমাদের তৈরি করা শ্যাম্পু লিকুইড দিয়ে নরমাল শ্যাম্পুর মত চুল ধুয়ে নিন। প্রথম বার বেশিক্ষণ চুলে ফেনা থাকবে না। তবে ফেনার আশায় বেশি লিকুইড নেয়ার দরকার নেই, এতে অতিরিক্ত রিঠা চুল শুষ্ক করে ফেলতে পারে। চুল এমনিতেই পরিষ্কার হবে। তিন চার মিনিট ভালো ভাবে মাথা ম্যাসেজ করে ধুয়ে ফেলুন।
- মাথায় যদি তেল দেয়া হয় তবে পুরো প্রক্রিয়া টি তেল কেটে না যাওয়া পর্যন্ত করুন।
উপকারিতাঃ
- সম্পূর্ণ কেমিক্যাল বিহীন।
- চুল পড়া বন্ধ করে আর নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
- খুবই কম খরচে তৈরি করা যায়। রেগুলার ব্যবহার করলে নরমাল শ্যাম্পু কন্ডিশনারের খরচ পুরটাই বেঁচে যাবে।
- চুলের ফ্রিজি ভাব কমায়
- চুলের গোঁড়া শক্ত করে।
- খুশকি আর উকুন দুর করে।
- চুল আস্তে আস্তে স্ত্রেইট করে ফেলে।
- শিকাকাই চুল সিল্কি, মসৃণ করে। সিলিকন যুক্ত কন্ডিশনারের কোন দরকারই হবেনা আর আপনার।
এর একমাত্র সমস্যা এটা তৈরি করতে সময় অনেক লাগে আর পদ্ধতি টা একটু মেসি। কিন্তু এটা আমার চুল পড়া এতই কমিয়ে দিয়েছে যে আমার একটু সময় নিয়ে এটা বানাতে আর খারাপ লাগে না। যখন দেখবেন আপনারও চুল ঝলমলে, পরিষ্কার আর তাও বাজারের নামি দামি শ্যাম্পুর দশ ভাগের এক ভাগ দামে, আর বাথরুমের মেঝেতে আর একটা চুল ও পড়ে নেই তখন আপনিও বুঝতে পারবেন এর ক্ষমতা। তো আর দেরি কেন? আজই চুল পড়া থামান, রিঠা আর শিকাকাইয়ের গুণে।
লিখেছেনঃ মীম তাবাসসুম
ছবিঃ উইকিটক্স.কম