গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে অনেক মায়েরই ভালো ধারণা নেই। এটি গর্ভবতী মায়েদের জন্য অনেক বড় ঝুঁকি। একটি সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই মায়েদের কত স্বপ্ন অনাগত সন্তানকে নিয়ে। এই স্বপ্ন যেন তাদের দুঃস্বপ্ন নিয়ে শেষ না হয় তার জন্য গর্ভবতী মায়েদের যত্নআত্তির অংশ হিসেবে আজ কথা হবে গর্ভকালীন মায়েদের একটি অন্যতম বিপদের কারণ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে। প্রেগন্যান্সি ইন্ডিউসড হাইপারটেনশন বলতে শুধুমাত্র সে সব মায়েদের উচ্চ রক্তচাপকে বোঝায় যাদের গর্ভকালীন প্রথমবারের মত উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায়। এর অন্তর্ভুক্ত রোগগুলো হচ্ছে –
১. গ্যাস্টেশনাল হাইপারটেনশন (Gestational hypertension)
২. প্রি-এক্লাম্পসিয়া (Pre-eclampsia)
৩. এক্লাম্পসিয়া (Eclampsia)
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ
অনেক মায়েরই গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায় কিন্তু এর সাথে প্রস্রাবে প্রোটিন (proteinuria), গোড়ালিতে পানি জমা ইত্যাদি হয় না। আর প্রি-এক্লাম্পসিয়া তখনই হবে যখন এই লক্ষণগুলোও থাকবে। আর প্রি-এক্লাম্পসিয়া যখন জটিল আকার ধারণ করে মাকে ফিট বা অজ্ঞান করে তখন একে এক্লাম্পসিয়া বলে। মূলত এটি একটি গ্রিক শব্দ থেকে আগত যার মানে sudden occurrence। এই রোগের ধরণটাই যে এমন।
এতক্ষণ ছিল পরিচয়ের পালা। এখন জেনে নেই কিভাবে বুঝবো এটি উচ্চ রক্তচাপ বা এর সাথে প্রস্রাবে প্রোটিন যাচ্ছে কিনা বা পায়ের গোড়ালিতে পানি জমা হয়েছে কিনা।
উচ্চ রক্তচাপ
রক্তচাপ সাধারণত ১৪০/৯০ বা এর বেশি হলেই এবং অন্তত পক্ষে ৬ ঘণ্টার ব্যবধানে দুই বার বেশি আসলেই রক্ত চাপ বেশি বলে ডাক্তাররা ধারণা করে থাকেন। এখানে একটি ব্যাপার আছে। অনেকের স্বাভাবিকভাবেই রক্ত চাপ বেশি। তাদের ক্ষেত্রে বা যে কারো পূর্বের রক্ত চাপের উপরের ঘরটি ৩০ এর বেশি ও নিচেরটি ১৫ এর বেশি হলে তবেই তার রক্তচাপ বেশি বলা হবে।
প্রস্রাবে প্রোটিন নিঃসরণ
অন্তত ৪ ঘণ্টা ব্যবধানের দুটি প্রস্রাব স্যাম্পলে ১ গ্রাম/লিটার প্রোটিন বা o.৩ mg (২৪ ঘণ্টায়) এর বেশি প্রোটিন গেলে তবেই একে proteinuria বলে। একটি সহজ পরীক্ষা হাসপাতালে গিয়ে করাতে পারেন। HCT (heat coagulation test) টেস্ট টিউবের ২/৩ অংশ প্রস্রাব নিয়ে প্রস্রাব জ্বাল দিলে প্রোটিন থাকলে প্রস্রাব ঘন হয়ে ঘোলাটে রং ধারণ করবে। আয়ারাও এই পরীক্ষাটি করতে পারে।
পায়ে পানি আসা
গর্ভকালীন অনেকের এমনিতেও পানি আসে। এতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু ওজন খুব বেড়ে গেলে বা সকালে ঘুম থেকে উঠে পা ফুলে যেতে দেখলে এবং সবচেয়ে জরুরী অর্থাৎ অন্যান্য লক্ষণগুলো থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
যারা এই সমস্যাগুলোতে বেশি আক্রান্ত হন –
১. প্রথম বারের মত সন্তান হবে যাদের (বিশেষ করে যাদের বয়স খুব কম বা বেশি)।
২. পরিবারের অন্য সদস্যদের কারো এমনটি পূর্বে হয়ে থাকলে।
৩. প্লাসেন্টা বা অমরার কোন সমস্যা থাকলে।
৪. গর্ভথলিতে পানির পরিমাণ বেশি হলে।
৫. জিনগত কারণে।
৬. হৃদপিণ্ড বা বৃক্কে আগে থেকে কোন সমস্যা থাকলে ইত্যাদি।
নিয়মিত চেকআপ হলেই আপনার সমস্যাগুলো ধরা পড়ে যাবে। WHO এর মতে একজন গর্ভবতী মা এর ১৩টি ভিজিট জরুরী, এর মধ্যে ৪টি ভিজিট অতীব জরুরী। আপনার যদি এই রোগগুলোর কোন একটি দেখা দেয় বা পাশাপাশি অন্য সমস্যা দেখা দেয় তবে আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই নরমাল ডেলিভারি সম্ভব নয় এবং সিজার করা ভালো। আপনার শারীরিক অবস্থা এবং অন্যান্য পরীক্ষা করে ডাক্তারই আপনাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন।
প্রি-এক্লাম্পসিয়া হলে কী কী সমস্যা হতে পারে?
১. এক্লাম্পসিয়া (গর্ভকালীন, প্রসবকালে, প্রসব পরবর্তী সময়ে)।
২. রক্তপাত (গর্ভকালীন, প্রসবকালে, প্রসব পরবর্তী সময়ে)।
৩. রোগী শকে চলে যেতে পারে।
৪. প্রসব পরবর্তী সময়ে sepsis হতে পারে।
৫. বাচ্চা গর্ভে মারা যেতে পারে, অপুষ্ট সন্তান হতে পারে, বাচ্চার শ্বাস কষ্ট হতে পারে।
এক্লাম্পসিয়া হলে কী কী সমস্যা হতে পারে?
১. নিউমোনিয়া, ফুসফুসে পানি জমা, শ্বাস কষ্ট, এম্বলিজম।
২. হৃদপিণ্ডের ও বৃক্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে।
৩. মস্তিষ্কে রক্তপাত হওয়া, পানি জমে যাওয়া।
৪. যকৃত আক্রান্ত হতে পারে।
৫. বাচ্চা গর্ভে মারা যেতে পারে, অপুষ্ট সন্তান হতে পারে, বাচ্চার শ্বাস কষ্ট হতে পারে।
এখন আপনাদের মনে অবশ্যই আসবে এত এত সমস্যা যে হতে পারে, তা থেকে বাঁচার উপায়?
১. রুটিন চেকআপঃ সন্তান পেটে আসার পর থেকেই নিয়মিত কোন হেলথ কমপ্লেক্স বা ডাক্তারের অধীনে গর্ভকালীন সব চেকআপ করাতে হবে। খরচের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। অনেকেই ভাবে আল্লাহ সন্তান দিয়েছেন। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাই এত ঘন ঘন ডাক্তার দেখাব কেন? আল্লাহ অবশ্যই আমাদের চেষ্টা করতে বলেছেন। এই ভেজালের যুগে সব কিছুই দূষিত তাই যত্ন নিতে হবে অনেক বেশি। যদি প্রথমেই আপনার সমস্যা ধরা পড়ে এবং নিয়মিত প্রেসারের ওষুধ খান এবং বিশ্রামে থাকেন তবে ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। তাছাড়া চেকআপগুলো কোন সরকারি হাসপাতাল বা হেলথ কমপ্লেক্স অনেক কম খরচে করা হয়ে থাকে।
২. এক্লাম্পসিয়া অনেক সময় প্রি-এক্লাম্পসিয়ায় না গিয়ে সরাসরি হয়ে যায়, এই অবস্থা প্রতিরোধ্য নয়। কিন্তু অন্যান্য অবস্থায় সচেতন থাকলে বিপদ এড়ানো যাবে, ইনশাল্লাহ।
৩. ঘুমের ওষুধ, প্রেসারের ওষুধ বা অজ্ঞান হওয়া এড়াতে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ প্রসবের পরও খেতে হবে। কারণ প্রসব পরবর্তী সময়েও মা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশে মোট মাতৃত্ব জনিত মৃত্যুর ১৪-২২% হয় এক্লাম্পসিয়া জনিত জটিলতায়। তাই হেলাফেলা না করে নিয়মিত চেকআপে থাকুন এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন। আপনার একটি ছোট পদক্ষেপ আপনার প্রিয় সন্তানের জন্যে অনেক বড় আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে।
ছবিঃ সংগৃহীত – আইস্টুডেন্টনার্স.কম, সাটারস্টক