সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাধারা ও জীবনযাত্রায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। বেশিরভাগ মেয়েরা এখন উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করছে। নানা কারণে বিয়ে ও ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে দেরি হয়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সামাজিক রীতিনীতিতে বেশ লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। বেশি বয়সে প্রথমবার গর্ভধারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। ৩০ বছরের পর গর্ভধারণের ক্ষেত্রে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে, চলুন জেনে নেই আজ।
নারীর বন্ধ্যাত্ব
বন্ধ্যাত্ব এমন এক সমস্যা যা নারী বা পুরুষ যে কারো হতে পারে, আবার উভয়েরও হতে পারে। বয়স ত্রিশের কোঠায় গেলে নারীদের শারীরিক জটিলতা বাড়তে পারে। কিন্তু প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করার সময় এই বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। নারীর বন্ধ্যাত্ব বলতে, সন্তান নেওয়ার লক্ষ্যে কোনো প্রোটেকশন ছাড়াই এক বছর নিয়মিত মিলনের পরেও গর্ভধারণ করতে না পারাকে বোঝায়। বয়সের পাশাপাশি হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, অনিয়মিত পিরিয়ড, কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা ও শারীরিক নানা ত্রুটিও বন্ধ্যাত্বের কারণ হতে পারে।
বয়স বৃদ্ধির সাথে প্রজনন ক্ষমতা কেন কমে যায়?
একজন নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করার মেইন ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে একটি হলো বয়স। যদিও পুরুষেরা সারা জীবন শুক্রাণু তৈরি করতে পারে, মেয়েরা সীমিত সংখ্যক ডিম্বাণু নিয়ে জন্মায় যেগুলো বয়সের সাথে সাথে পরিমাণে ও গুণগতমানে হ্রাস পায়। একজন নারীর বয়স যখন ত্রিশের ঘরে পৌঁছায়, তখন তার ফার্টিলিটি হ্রাস পেতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। বয়স ৩৫ পার হলে জটিলতা আরও বাড়তে পারে। তার মানে এই না যে ৩০/৩৫ এ গেলে আপনি কনসিভ করতে পারবেন না! তবে জটিলতার সম্ভাবনা থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ডিম্বাণুর সংখ্যা ও গুণগতমান কমতে থাকে, তাই প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। ডায়াবেটিস, থাইরয়েড প্রবলেম, হাই ব্লাড প্রেশার এগুলোও বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দেখা দেয়। তখন কনসিভ করার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
৩০ বছরের পর গর্ভধারণের ক্ষেত্রে যত বিপত্তি
১) ডিম্বাশয়ের রিজার্ভ হ্রাস পাওয়া
একজন নারীর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার ডিম্বাশয়ের রিজার্ভ হ্রাস পায়, অর্থাৎ নিষিক্তকরণের জন্য হেলদি এগ এর সংখ্যা কমে আসে। যা গর্ভধারণের ক্ষেত্রে অসুবিধা সৃষ্টি করে এবং আর্লি মিসক্যারেজের ঝুঁকি বাড়ায়।
২) কনসিভ করতে সময় বেশি লাগে
৩০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের গর্ভধারণের জন্য তুলনামূলক বেশি সময় লাগতে পারে। মানে ২৪/২৫ বছরের একজন নারীর হয়তো স্বাভাবিকভাবে এক দুই মাস ট্রাই করার পরই পজেটিভ রেজাল্ট আসছে, কিন্তু ৩৩/৩৫ এ এসে কনসিভ করতে বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। এখানে শারীরিক ও মানসিক বিষয় জড়িত।
৩) ঝুঁকিপূর্ণ মেডিকেল কন্ডিশন
বয়স বাড়লে বিভিন্ন মেডিকেল কন্ডিশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা প্রজনন ক্ষমতার উপর নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলে। যেমন, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এন্ডোমেট্রিওসিস, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম, ফাইব্রয়েড বা জরায়ুর টিউমার, ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লক হয়ে যাওয়া ইত্যাদির ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পায় এবং এগুলো গর্ভধারণকে জটিল করে তোলে।
৪) ক্রোমোজোমাল অ্যাবনরমালিটির ঝুঁকি বৃদ্ধি
বাচ্চার ক্রোমোজোমাল অ্যাবনরমালিটির ঝুঁকি (যেমন ডাউন সিন্ড্রোম) মায়ের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মিসক্যারেজ হতে পারে, জেনেটিক ত্রুটিসহ শিশুর জন্মের হারও বৃদ্ধি পেতে পারে।
৫) আই ভি এফ করাতে হতে পারে
ইনফার্টিলিটির কারণে আই ভি এফ(IVF) পদ্ধতি বেছে নিতে হতে পারে, যার সাকসেস রেট আমাদের দেশে কিন্তু বেশ কম। এই ট্রিটমেন্টগুলো স্ট্রেসফুল ও লেন্থি, আবার এগুলো বেশ ব্যয়বহুল।
৬) মিসক্যারেজের ঝুঁকি বৃদ্ধি
গবেষণায় দেখা গেছে যে ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী মায়েদের মধ্যে মিসক্যারেজের ঝুঁকি সবচেয়ে কম এবং ৩০ বছর বয়সের পরে এই হার বৃদ্ধি পায়। ৩০ বছর বয়সে মিসক্যারেজের ঝুঁকি শতকরা ১২ ভাগ, ৩৫ বছর বয়স হতে হতে যা বৃদ্ধি পেয়ে শতকরা ১৮ ভাগ হয়ে যায়।
৭) মাল্টিপল প্রেগনেন্সির ঝুঁকি বৃদ্ধি
এই বয়সে মাল্টিপল প্রেগনেন্সির সম্ভাবনা বেশি থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে এটি ঘটতে পারে। একাধিক সন্তান গর্ভধারণের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো প্রিটার্ম বার্থ বা সময়ের আগেই সন্তান জন্মদান, যা প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে। এই শিশুরা সাধারণত কম ওজন নিয়ে জন্মায় এবং তাদের নিবিড় পরিচর্যার (NICU) প্রয়োজন হয়।
যদিও ৩০ বছরের পর গর্ভধারণের ঘটনা আমাদের আশেপাশে অহরহ হচ্ছে, এই বয়সে স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করা সম্ভব, তবে সময়ের সাথে সাথে জটিলতা বাড়তে থাকে এবং সেটি হাই রিস্ক প্রেগনেন্সি ক্যাটাগরিতে চলে যায়। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যারিয়ার নাকি সন্তান, আপনার ফার্স্ট প্রায়োরিটি কোনটি, এই বিষয়ে নিজেকে আগে প্রশ্ন করুন। একেক জনের লাইফ গোল বা ফিউচার প্ল্যান, আর্থিক অবস্থা একেক রকম। আপনার পার্টনার কী চাচ্ছেন, দু’জনের শারীরিক কন্ডিশন কেমন – সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক