ইদানিং সজল তার বাড়ির কারও সাথে বেশি কথা বলে না। এমনকি কেউ তার খাবার বেড়ে দিলে সেটাও সে খায় না। তার ধারণা অন্যের দেওয়া খাবারে বিষ মেশানো আছে। আবার, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কেউ সজলের দিকে তাকালে মনে হয় সেই ব্যক্তি বুঝি তার মনের গোপন কথা জেনে যাচ্ছে। এমন আচরণে দিন দিন আশেপাশের সবার সাথে সজলের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। সজল যে সমস্যায় ভুগছে তার নাম সিজোফ্রেনিয়া। আজকের আর্টিকেল থেকে আমরা জানবো সিজোফ্রেনিয়া কী, এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আচরণ কেমন হয় এবং এর কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে।
সিজোফ্রেনিয়া কী?
সিজোফ্রেনিয়া হলো এক ধরনের জটিল মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বাস্তব চিন্তা একদম কমে যায়, বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন হয়, গায়েবি আওয়াজ শুনতে পায়, যা ঘটেনি বা যা নেই এমন জিনিসে বিশ্বাস করে। এটি মূলত সাইকোটিক ডিজঅর্ডার। এ রোগীরা মানতে চায় না যে তারা কোনো রোগে ভুগছে। এ জন্য কোনো চিকিৎসকের কাছেও তারা যায় না।
সিজোফ্রেনিক রোগীরা দিন দিন একা হয়ে যায়। যার কারণে তাদের আচার-আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে। তাদের নিজেদের মন, চিন্তাশক্তি, অনুভূতি বা ইচ্ছেশক্তি কোনো কিছুতেই তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যেমন- হাসির কোনো কারণ ছাড়া রোগী হয়তো একাই হাসে, কানে আওয়াজ শুনে বিড়বিড় করে কথা বলে। এসবের পরও রোগী কখনো ভাবে না সে সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে। সে পুরোপুরি তার নিজের আলাদা কাল্পনিক জগত তৈরি করে নেয়। এই দুনিয়াই তার পুরো জীবনকে প্রভাবিত করে।
বৈশিষ্ট্য
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের কয়েক ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকে। তাদের কাজ, চিন্তা, আচরণ ও ব্যক্তিত্বে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হচ্ছে-
১) পজিটিভ বৈশিষ্ট্য
বৈশিষ্ট্যের নাম পজিটিভ হলেও এটি কিন্তু মোটেও পজিটিভ কোনো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। বরং এই বৈশিষ্ট্য অনেকখানি জটিল। এই বৈশিষ্ট্যের আবার তিনটি ভাগ আছে। সেগুলো হচ্ছে-
বিভ্রান্তি (Delusion)
ডিল্যুশন হলো এমন একটি বিশ্বাস যার আসলে বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। রোগীর মাঝে প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা থাকে। রোগী কোনো অশরীরীর কথা শুনতে পাচ্ছে, বহুদূর থেকে কেউ তার সাথে কথা বলছে, অন্য কোনো ব্যক্তি তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে- সব সময় এমন ভাবনা থাকে।
হ্যালুসিনেশন (Hallucination)
এ ক্ষেত্রে রোগী অবাস্তব জিনিস দেখতে থাকে বা অনুভব করে। সহজ ভাষায়, যে জিনিসের অস্তিত্ব নেই, মস্তিষ্ক সেটি নিজ থেকে তৈরি করে ফেলে। অদ্ভুত কোনো গন্ধ পাওয়া বা শরীরে কিছু না থাকা সত্ত্বেও শরীর কিছু স্পর্শ করছে এমন সমস্যাও দেখা যায়।
পেশী অসাড় হয়ে যাওয়া (catatonia)
রোগী দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে থাকলে ধীরে ধীরে তার পেশী অসাড় হয়ে যায়। যার কারণে সেখান থেকে নড়ার জন্য সে শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেলে।
২) কগনিটিভ বৈশিষ্ট্য
নির্দিষ্ট কোনো কাজে মনোযোগ না দিতে পারা, সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা হওয়া, কোনো কিছু মনে না থাকা এসব কগনিটিভ বৈশিষ্ট্যের অংশ।
৩) নেগেটিভ বৈশিষ্ট্য
এই নেগেটিভ অর্থ ব্যক্তির মাঝে কিছু আচরণ বা ব্যবহারের অনুপস্থিতি। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে-
- আবেগের উপস্থিতি একদম কম থাকা
- পরিবার বা বন্ধু বান্ধবের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া
- সামাজিক যে কোনো কাজ বা অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া
- শরীরের যত্ন না নেওয়া
- যে কোনো বিষয়েই কথাবার্তা একদমই কম বলা অথবা না বলা
- জীবন নিয়ে কোনো আগ্রহ না থাকা
- শক্তি ধীরে ধীরে কমে আসা
কেন হয়?
সিজোফ্রেনিয়া কেন হয় তার নির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও এই রোগ হওয়ার পেছনে কয়েকটি ফ্যাক্টর রয়েছে। যেমন-
১) বংশগত কারণ
বাবা বা মা যে কোনো একজনের মধ্যে এই রোগটি থাকলে সন্তানেরও এতে আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ২০% সম্ভাবনা থাকে। যদি দুজনেরই থাকে, তাহলে ৪৫% সম্ভাবনা থাকে যে সন্তানও এ রোগে আক্রান্ত হবে। সিজোফ্রেনিয়া রোগটি সৃষ্টির জন্য নির্দিষ্ট একটি নয়, বরং আটটি জিন দায়ী। এই জিনগুলোর বিশৃঙ্খলার কারণে রোগটি হয়।
২) ব্রেইন কেমিস্ট্রি
মানুষের ব্রেইনে কিছু কেমিক্যাল থাকে যেগুলো এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনিয়মিত থাকে। এ কারণে তাদের আচরণে বেশ প্রভাব পড়ে।
৩) পরিবেশগত কারণ
সিজোফ্রেনিয়া রোগটি সাধারণত অল্প সময়ে হয় না। শৈশব থেকেই এ রোগের বীজ মনের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকে। শিশুর পারিপার্শ্বিকতা যদি টক্সিক হয়, অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয় এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শিশু বা কিশোরকে যেতে হয়, তবে তাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সিজোফ্রেনিয়া কাদের মাঝে দেখা দেয়?
নারী ও পুরুষসহ যে কোনো ব্যক্তি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলেও নারীদের তুলনায় পুরুষদের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যে কোনো বয়সেই রোগটি হতে পারে। সাধারণত পুরুষদের কিশোর বয়সে অথবা ২০-২২ বছর বয়সে এবং নারীদের ২৫-৩৫ বছর বয়সে প্রথম দেখা দেয়।
নির্ণয় পদ্ধতি ও চিকিৎসা
সিজোফ্রেনিয়া নির্ণয়ের নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা নেই। রোগীর মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পেলে চিকিৎসক আগে মেডিকেল হিস্টরি জানবেন এবং পরবর্তীতে ব্লাড টেস্ট, ব্রেইন ইমেজিং স্টাডিসহ বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন। রোগীর মধ্যে যদি অন্তত ৬ মাস সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ থাকে তাহলে বুঝতে হবে সে এ রোগে ভুগছে।
সিজোফ্রেনিয়ার কোনো প্রতিকার না থাকলেও অনেক রোগী ন্যূনতম উপসর্গের সাথেই সমাজে চমৎকারভাবে মিলেমিশে চলতে পারে। চিকিৎসা হিসেবে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। যেমন-
১) ওষুধ
এ রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণত অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অসুস্থতার তীব্র পর্যায়ে সাইকোটিক লক্ষণ হ্রাস করতে, পরবর্তীতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে, ডিল্যুশন ও হ্যালুসিনেশন কমাতে এই ওষুধগুলো কাজ করে।
২) মানসিক চিকিৎসা
সাইকোথেরাপি সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া মানসিক চিকিৎসা করেও উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। রোগী যদি নিয়মিত থেরাপি নেন তাহলে কর্মসংস্থানে কাজ করতেও সমস্যা হয় না।
৩) হাসপাতালে ভর্তি
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ তেমন বিপজ্জনক বা হিংস্র নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। রোগীর দ্বারা অন্যদের ক্ষতি হতে পারে অথবা বাড়িতে যত্ন না নেওয়া গেলে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করানো যায়।
৪) ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ECT)
এই থেরাপিতে ঘুমন্ত অবস্থায় রোগীর মাথায় অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে ইলেকট্রোড লাগানো হয় এবং কারেন্টের ছোট একটা শক দেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে ২-৩ বার করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত এই থেরাপি চালু থাকে। এতে রোগীর মানসিক অবস্থা এবং চিন্তার উন্নতি হয়। তবে রোগীর এই থেরাপির প্রয়োজন আছে কিনা সেটি চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলে ভয় না পেয়ে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করা উচিত। এটি পুরোপুরি প্রতিরোধ করা না গেলেও চিকিৎসা ও থেরাপির মাধ্যমে সামাজিকভাবে বিভিন্ন কাজ করা এবং পরিবারের সাথে থাকা সম্ভব। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক