ছোটবেলা থেকেই একটি শিশু পরিবারের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী এমনকি বাবা মায়ের কাছ থেকেও শুনে যে সে কালো হয়েছে। কথাটা সরাসরি বলা না হলেও ইনিয়ে-বিনিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে তার গায়ের রংটা অন্য ভাইবোনদের মতো উজ্জ্বল হয়নি কিংবা গায়ের রং এর জন্য তাকে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। আর তাই ছোটবেলা থেকেই শিশুটি মনে করা শুরু করে যে ‘ফর্সা মানেই সুন্দর’। আর এই ফর্সা হওয়ার ইচ্ছাটাকে পুঁজি করেই ব্যবসা করে নেয় ফেয়ারনেস ক্রিমগুলো।
কিন্তু সত্যিই কি গায়ের রংকে ফর্সা করার ক্ষমতা আছে এই ফেয়ারনেস ক্রিমগুলোর?
[picture]
প্রায় সব ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনেই দেখা যায় যে, মেয়েটির বা ছেলেটির গায়ের রং শ্যামলা তার খুব মন খারাপ কিংবা সে কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করতে পারছে না। এরপরেই দেখা যায় ত্বক ফর্সা করার ক্রিমের ব্যবহার করে সে খুব ফর্সা হয়ে গেছে এবং কর্মক্ষেত্রে কিংবা বিয়ের বাজারে তার দাম বেড়ে গেছে। এই ধরণের বিজ্ঞাপনগুলো রং বৈষম্য বাড়ানোর পাশাপাশি নানান রকম মানসিক সমস্যা তৈরি করছে। একই মেধা এবং একই চেহারা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র গায়ের রং এর জন্য পিছিয়ে থাকার এই মানসিকতা সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
ত্বকের রং কি রকম হবে তা মূলত নির্ভর করে জেনেটিক, জাতিগত এবং মেলানিন স্ট্রাকচারের উপর। বেশিরভাগ ডারমাটোলজিস্টদের মতে ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহারে ত্বকের রং মাত্র ২০% উজ্জ্বল করা সম্ভব। এর বেশি কোনোভাবেই ফর্সা হওয়া সম্ভব না। ফেয়ারনেস ক্রিমগুলো মূলত রোদে গেলে সান ব্লকের কাজ করে এবং ত্বকে মেলানিন বেড়ে যেতে বাধা দেয়। ফলে ত্বক রোদে পোড়ে না এবং আগের পোড়া ভাবটাও ধীরে ধীরে কমে যায়। ফলে ত্বক কিছুটা উজ্জ্বল দেখায়। কিন্তু ফেয়ারনেস ক্রিম কখনই মানুষের ন্যাচারাল স্কিন কালার পরিবর্তন করতে পারে না। ত্বকের মেলানিন স্ট্রাকচারটা কোনো ফেয়ারনেস ক্রিমই পরিবর্তন করতে পারে না। ব্যাপারটার সাথে কোকড়া চুলের তুলনা দেয়া যায়। কোকড়া চুল ন্যাচারালি সোজা করা যায় না এবং কেমিক্যাল দিয়ে সোজা করলেও গোড়া থেকে আবার কোকড়া চুলই গজায়। ঠিক একইভাবে ফেয়ারনেস ক্রিমও শুধু ত্বকের উপরের লেয়ারটাকেই কিছুটা উজ্জ্বল করে কিন্তু গায়ের আসল রংটাকে পরিবর্তন করতে পারে না।
এবার আসা যাক আসলে কী থাকে এই রং “ফর্সাকারি” ফেয়ারনেস ক্রিমে?
- হাইড্রোকুইনান
প্রায় প্রতিটি ফেয়ারনেস ক্রিমেই এই উপদানটি থাকে। এটা মূলত মেলানিন তৈরিকে বাধা দেয়। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে এই উপদানের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। ফলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করলে ত্বক ফর্সা হওয়ার বদলে আরো ডার্ক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি এই উপাদানটি ফ্রান্সে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারণ এই উপাদান ব্যবহারের কারণে ক্যান্সারও হতে পারে।
- কজিক এসিড
এই উপাদানটিও মেলানিন তৈরিকে বাধা দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
- রেটিনয়িক এসিড
এই উপাদানটি ত্বকের উপরের লেয়ারটিকে সরিয়ে দিয়ে নিচের লেয়ারটি বের করে আনতে সহায়তা করে।
- প্ল্যান্ট এক্সট্র্যাক্ট
কিছু ভেষজ উপাদান থাকে ফেয়ারনেস ক্রিমগুলোতে। এই উপাদানগুলো ত্বকের কোন ক্ষতি করে না।
স্টেরয়েড এবং ক্ষতিকর এই রাসায়নিক উপাদানগুলো শরীরে যে বিরূপ প্রভাবগুলো ফেলতে পারে সেগুলো হলো-
– ত্বকের চামড়া পাতলা করে দেয়া
– ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ
– ব্রণের সমস্যা
– সূর্যের আলোতে ত্বক জ্বালাপোড়া এবং র্যাস ওঠা
– আন ওয়ান্টেড ফেসিয়াল হেয়ার
– অ্যালার্জি
– কিডনির সমস্যা
– ক্যান্সার
ফেয়ারনেস ক্রিম সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা-
(১) ফেয়ারনেস ক্রিম রং ফর্সা করে
ফেয়ারনেস ক্রিম রং ফর্সা করতে পারে না। এটা শুধুমাত্র ত্বকের উপরের রোদে পোড়া লেয়ারটিকে সরিয়ে দেয় এবং মেলানিন এর বৃদ্ধি রোধ করে। কিছু ক্ষেত্রে এটা ত্বককে ব্লিচ করে উজ্জ্বল করে যা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর।
(২)সব উপকরণ প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে
সব সময়ে সব উপকরণ প্যাকেটের গায়ে লেখা নাও থাকতে পারে। অনেক সময় কিছু ক্ষতিকর উপাদান উল্ল্যেখ করা হয় না প্যাকেটে। আবার দেখা যায় উপকরণগুলোর নাম লেখা থাকলেও পরিমাণ উল্ল্যেখ করা হয় না।
(৩) ডার্ক স্কিনের চাইতে ফর্সা ত্বক ভালো
চিকিৎসকদের মতে ডার্ক ত্বকের অধিকারীরা অনেক সমস্যাই এড়াতে পারেন। ফর্সা ত্বকের তুলনায় তাদের স্কিন ক্যান্সার, অ্যালার্জি, র্যাস কিংবা চর্ম রোগ অনেকটাই কম হয়। ত্বকে মেলানিন বেশি থাকার কারণে ত্বকের সমস্যাগুলো কম হয় ডার্ক স্কিনধারীদের।
(৪) আয়ুর্বেদিক কিংবা হারবাল ফেয়ারনেস ক্রিমে কেমিক্যাল নেই
অনেকেই মনে করেন যে আয়ুর্বেদিক কিংবা হারবাল ফেয়ারনেস ক্রিমে কোনো ক্ষতিকর কেমিক্যাল নেই। শুধুমাত্র ভেষজ উপাদান দিয়েই তৈরি ভেবে রং ফর্সা করার জন্য অনেকেই এই ক্রিমগুলো ব্যবহার করেন। কিন্তু এই ক্রিমগুলোতেও থাকে ক্ষতিকর কেমিক্যাল বেইজ এবং প্রিজারভেটিভ যা ত্বকে এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
তাহলে কী করা উচিত?
– প্রতিদিন অন্তত তিনবার পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করবেন।
– প্রতিদিন সকালে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময়ে ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করবেন।
– রোদে যাওয়ার আগে অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন।
– প্রতিদিন ৭/৮ গ্লাস পানি খাবেন।
– ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাবেন।
– কাচা হলুদ, টমেটোর রস, যষ্টি মধু, কাচা দুধ, অ্যালোভেরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান সমৃদ্ধ ফেইস প্যাক ব্যবহার করবেন সপ্তাহে ৩ বার।
ত্বকের রং ফর্সা করার জন্য ক্ষতিকর ফেয়ারনেস ক্রিমগুলো ব্যবহার না করে ত্বককে সুস্থ রাখার চেষ্টা করুন। প্রাকৃতিক উপায়ে ত্বকের যত্ন নিলেই ক্ষতিকর সূর্যরশ্মির প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করতে পারবেন। নিয়মিত ত্বকের যত্নে ত্বক হয়ে উঠবে স্বাস্থোজ্জ্বল। আপনি যেমন আছেন, সেভাবেই নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন।
ছবি – স্কিনহোয়াইটেনসিক্রেত্র ডট কম
লিখেছেন – নুসরাত শারমিন