মেকাপ আর্টিস্ট তানশিয়াকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো কিছু নেই। বেশ কিছুদিন আগে প্রকাশিত ফ্রাইডে স্পেশাল ইন্টার্ভিউতে হাজির হয়েছিলেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারটি শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশী হিসেবে হলিউডের মতো একটি জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে না জানলে কি হয়! ওই ইন্টার্ভিউটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে স্পেশালইফেক্ট মেকাপে তার পথচলা এবং পেছনকার কাহিনী সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাই দ্বিতীয়বারের মতো তানশিয়া মুখমুখি হলেন সাজগোজের।
আমরা যারা এই ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ তাদের কাছে কমন প্রশ্ন মেকাপের সাথে স্পেশাল ইফেক্টের কি সম্পর্ক। তাই শুরুতেই তাকে এই প্রশ্ন করা…
হ্যাঁ, এই প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করেছেন। অনেকেই আসলে এর পার্থক্যটি কোথায় তা জানেন না। মেকাপ আর্টিস্ট মূলত একটি প্রফেশন আর এসএফএক্স (স্পেশাল ইফেক্ট মেকাপ) হল মেকাপেরই একটি শাখা। আর এই শাখাতে স্পেশালইজড ম্যাটেরিয়াল এবং টেকনিকের ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে মেকাপ করা করা হয়। যেটা কনভেনশনাল মেকাপে সম্ভব নয়। এবার একটু থেমে আরেকটু সহজ করে বলেন, হলিউডের ফিকশন মুভিগুলোতে বিভিন্ন ক্রিয়েচার, এলিয়েন এদের লুকগুলো মানুষের চেহারায় মেকাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার কাজটি আসলে স্পেশাল ইফেক্টের মেকাপের কাজ।
[picture]
এবার একটু জানতে ইচ্ছে হল এই পেশায় কীভাবে আসা হল? এই জগতে আসার পেছনের গল্প জানতে চাই…
মেকাপ আমার প্যাশন।শুরু থেকে বলতে গেলে প্রথম কিছু বছর নিজে নিজে মেকাপ করে আমি শিখেছি।আমার মনে আছে,প্রত্যেকবার করা এক্সপেরিমেন্ট এবং ভুলগুলো থেকেই আমি নিজেকে গড়তে শিখেছি।এভাবেই মেকাপের প্রতি আলাদা ভালো লাগা তৈরি এবং সেখান থেকেই এই প্রফেশনে আসা।
ম্যাক এবং নার্স এর মতো আন্তর্জাতিক মেকাপ ব্র্যান্ডের লিড মেকাপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করা তানশিয়া নিজেকে এয়ার ব্রাশ থেকে শুরু করে স্পেশাল ইফেক্টেও নিজেকে আরও পারদর্শী করতে চেয়েছিলেন।
গল্পে গল্পে জানতে পারলাম ধীরে ধীরে মেকাপ জগতের সবচেয়ে কঠিন স্পেশাল ইফেক্টের কাজের প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। এবং সেই আগ্রহ তাকে টেনে আনে হলিউডের মতো জায়গায়। তানশিয়ার কথা থেকে তো এতক্ষনে পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেল তানশিয়া ভালোলাগার জায়গাটিতে তার সবটুকু দিয়ে করেন। তিনি চেয়েছিলেন হলিউডের শীর্ষ এসএফএক্স আর্টিস্টের কাছ থেকে হাতেখরি নিবেন। তাই হল।
আপনার মতে এই পেশায় কী ফ্যাক্টোর (key factor) কি? এবং একজন এসএফএক্স মেকাপ আর্টিস্টের কাজের ধরণ সম্পর্কে যদি বলতেন…
আমি বলব ধৈর্য‘ডেডিকেশন’। এসএফএক্স (স্পেশাল ইফেক্ট মেকাপ) –এ অনেকগুলো স্তর রয়েছে। এতে moulding, casting, sculpting, animatronics, specialist rigs, painting, hair work, fabrication and the creation of custom tailored under suits, finishing, seaming, design, prosthetic application এর পাশাপাশি সাধারণ মেকাপ, ম্যাটেরিয়াল ডেভেলপমেন্ট এবং ইফেক্টস প্রসেসও ফলো করতে হওয়। বুঝতেই পারছেন কতগুলো কাজ করতে হয়। ধৈর্য না থাকলে প্রতিটি স্তর মেইনটেইন করা অসম্ভব!
বোঝাই যাচ্ছে, অনেক ডিটেইলিংয়ের মধ্য দিয়েই একজন এসএফএক্স মেকাপ আর্টিস্টকে কাজ করতে হয়। তানশিয়ার মুখ থেকেই জেনে নেয়া যাক এই প্রফেশনে বিগেস্ট চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে…
এই প্রফেশনে বিগেস্ট চ্যালেঞ্জ একটাই তা হল বাঁধা-ধরা সময়ের মধ্যে হাতে নেয়া কাজ শেষ করতে পারা। অল্প সময়ের মধ্যে ছোট থেকে ছোট ডিটেইলিংগুলো নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা অনেক কঠিন। কিন্তু তারপর এতো প্রেশারের মধ্যে যখন সময় মতো পারফেক্ট একটি আউটপুট পাই বেশ ভালো লাগে।
আপনার তো হলিউডের মতো জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশে অনেকেই আছেন যারা এই পেশায় আগ্রহী। তারা আসলে জানতে চায় কি ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন ইত্যাদি…
সত্যি কথা বলতে কি মেকাপ প্রফেশনে শিক্ষাগত যোগ্যতা আপনাকে সেভাবে নিশ্চিত কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে না। কেননা এটা একটি ক্রিয়েটিভ কাজ যেটা ভেতর থেকে আসতে হয় তাই এই প্রফেশনে অন্যান্য প্রফেশনের মতো শিক্ষাগত যোগ্যতার থেকে নিজেকে মেলে ধরতে সাহায্য করে ভেতরকার কল্পনা শক্তি। আপনাকে যা জানতে হবে তা হল ভেতর থেকে নিজের ক্রিয়েটিভ সত্ত্বাটিকে বের করে আনার কৌশল। মোট কথা, শিক্ষাই একজন শিল্পী কীভাবে হয়ে উঠতে হয় তা শেখাতে পারে না। তবে একথাও ঠিক যে স্টাডি, কর্মশালা, কোর্স অভিজ্ঞ শিল্পী থেকে নতুন কৌশল শিখতে সাহায্য করবে। যা পরবর্তীতে প্রফেশনে থিতু হতে অনেকটা হেল্প করবে।
কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে এসে তানশিয়াকে স্মরণীয় কোনো ঘটনার শেয়ার করতে বলা হলে তানশিয়া বলেন…
এসএফএক্স কোর্স শুরু দিকের কথা তখন আমি কেবল কোর্সে জয়েন করেছি মাত্র। আমাদের বলা হল একটা ভাস্কর্য তৈরি করতে হবে। আমি এর আগে কখনো মাটি দিয়ে কিছু তৈরি করিনি। খুব হতাশা কাজ করেছিল। খুব কেঁদেছিলাম এই ভেবে যে, আমাকে দিয়ে এসব হবে না। প্রায় প্রতিদিন বাবাকে ডেকে ডেকে বলতাম বাবা আমি বোধয় আর পারব না… আমাকে দিয়ে এসব হবে না। বাবা সাহস জোগাতেন বলতেন দেখ এটা খারাপ হয়েছে তো কি হয়েছে আরেকবার চেষ্টা কর দেখবে ভালো হচ্ছে। এর কয়েকদিন পরেই আমার বাবা মারা জান। খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম কোনকিছুতেই কোন কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। কি করব বুঝে উঠতে না পেরে Shanon Shea (জুরাসিক পার্ক, টারমিনেটর টু এবং জাজমেন্ট ডে এর মতো মুভিগুলোর মেকাপ আর্টিস্ট)-কে জানাই আমার প্ল্যান সম্পর্কে। উনি যখন দেখতে পেলেন আমি খুবই হতাশায় ভুগছি এবং কিছুতেই পরিকল্পনা মতাবেক কাজ করতে পারছিলাম না তখন আমাকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, আর কান্নাকাটি না করে এসএফএক্স বাবাকে (Shanon Shea) সারপ্রাইজ দিতে! তার ওই কথাগুলো আমাকে অনেক উদ্দীপ্ত করেছিলো। তাই তো নিজের বাবাকে হারানর কষ্ট চাপা দিয়ে ওই কোর্সের অন্য সবার আগে আমি ক্যারেক্টারটি শেষ করি। এবং তা ছিল ওই কোর্সের সেরা কাজগুলোর মধ্যে একটি।
অনেক অনেক শুভকামনা রইল আপানার জন্য…
সাজগোজকেও অনেক ধন্যবাদ।