অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (ADHD) একটি সাধারণ নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার যা বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ শিশুকে প্রভাবিত করে। বাংলায় এই সমস্যাকে বলে অতিচঞ্চলতা। সুস্থ–স্বাভাবিক শিশু খানিকটা চঞ্চল হবেই। সুস্থ শিশু মানেই হাসিখুশি ও দুরন্তপনা। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, চঞ্চলতা মানেই এডিএইচডি নয়। এডিএইচডিতে আক্রান্ত শিশুরা প্রায়ই মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারে না, হাইপার একটিভিটি ইত্যাদি সমস্যার সাথে লড়াই করে। এই অবস্থা একটি শিশুর একাডেমিক কর্মদক্ষতা, সামাজিক সম্পর্ক ও সামগ্রিক সুস্থতার উপর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। বাচ্চাদের হাইপারঅ্যাকটিভিটি থাকলে সঠিক সহায়তা ও সেবা প্রদানের জন্য বাবা-মা, শিক্ষক এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের এডিএইচডি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা জরুরী।
বাচ্চাদের হাইপারঅ্যাকটিভিটি এর কারণ
অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার রোগটি এর নামের মতই সবসময় মনোযোগের ঘাটতি ঘটায় না, বরং অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনোযোগের কারণ হয় যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয়। যদিও এডিএইচডি এর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি, তবে এ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে জেনেটিক্স, মূল বিকাশের সময় মস্তিষ্কের গঠনে অসামঞ্জ্যস্যতা, রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি কারণে এডিএইচডি দেখা দিতে পারে। এছাড়াও এডিএইচডি অনেক কারণের সংমিশ্রণে হয়ে থাকে বলেও ধারণা করা হয়।
এডিএইচডির ঝুঁকি কাদের বেশি থাকে
ADHD এর ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে
- রক্তের আত্মীয়, যেমন বাবা-মা, ভাইবোন, যাদের ADHD বা অন্য মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি রয়েছে।
- গর্ভাবস্থায় মায়ের বিভিন্ন রকম ওষুধ ব্যবহার, অ্যালকোহল সেবন বা ধূমপান।
- প্রি-ম্যাচিউর বার্থ বা সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশু।
- মৃগি রোগী বা বংশে কারো মৃগী রোগ থেকে থাকলে।
- শিশু গর্ভে থাকাকালীন সময়ে বা পরবর্তিতে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে থাকলে।
- মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার, বিশেষ করে ডোপামিন এবং নরএপিনেফ্রিন, মনোযোগ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নিউরোট্রান্সমিটারে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে ADHD এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
- পরিবেশগত কারণ যেমন, গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকর বিষাক্ত কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসা মায়ের শিশুদের এই রোগ দেখা দিতে পারে।
হাইপারঅ্যাকটিভিটি বা ADHD এর লক্ষণ
ADHD-এর লক্ষণগুলো শিশুদের মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে এবং তারা বড় হওয়ার সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে উপসর্গের দুটি প্রধান ধরন হল,
অমনোযোগিতা
কোনো কাজ করতে দিলে বা খেলাধুলা করতে গেলে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, অসতর্ক থাকা, কোনো কাজের নির্দেশ অনুসরণ করতে না পারা, দৈনন্দিন কাজকর্ম ভুলে যাওয়া। প্রায়ই স্কুলের বই খাতা বা খেলনার মত জিনিসপত্র হারানো ইত্যাদি অমনোযোগিতার লক্ষণ।
হাইপারঅ্যাকটিভিটি/ইম্পালসিভিটি
চুপচাপ কোথাও স্থির হয়ে থাকতে না পারা, অনুপযুক্ত পরিবেশেও অতিরিক্ত দৌড়ানো ও লাফালাফি করা, ক্লাস রুম বা অন্যান্য জায়গায় সর্বক্ষন চঞ্চলতা, নিজে সদা ব্যস্ত থাকা ও অন্যদেরও ব্যস্ত রাখা, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা বা কথা বলা বা অন্যের কথার মাঝখানে বাধা দেয়া, অন্য শিশুদের খেলায় বাধা প্রদান করা ইত্যাদি হাইপারঅ্যাকটিভিটির লক্ষণ। তবে এটি মনে রাখা জরুরী যে শিশুদের মধ্যে কিছু মাত্রার অমনোযোগিতা এবং হাইপারঅ্যাকটিভিটি স্বাভাবিক, কিন্তু ADHD-এ আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দেখা যায় এবং এর ফলে তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে।
এডিএইচডি নির্ণয় কীভাবে করা হয়
এডিএইচডি নির্ণয় একটি জটিল প্রক্রিয়া। কয়েক প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এডিএইচডি নির্ণয় করা যায়। শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, শিশু মনোবিজ্ঞানী, বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য, শিক্ষক এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের থেকে শিশুর আচরন সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য প্রয়োজন হয়। তবে এডিএইচডি নির্ণয় করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন শেখার অক্ষমতা বা লার্নিং ডিজেবিলিটি, মানসিক সমস্যা, ডিপ্রেশন ইত্যাদি সমস্যার লক্ষণ এক হলেও সেটি এডিএইচডি নয়।
এই রোগের চিকিৎসা কী হতে পারে
অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকাংশেই এডিএইচডি নিরাময় সম্ভব। ঔষধ বা থেরাপির মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা সম্ভব, তবে সম্মিলিতভাবে দুই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করাই সবথেকে ভালো। চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধের মাধ্যমে এডিএইচডি পুরোপুরি নিরাময় না হলেও শিশুদের কাজে মনযোগী হতে, ধীর-স্থির হতে, আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। তবে এই সমস্ত ঔষধ লম্বা সময় ব্যবহার করলে অনেক রকম সাইড ইফেক্ট দেখা দিতে পারে। তাই নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হবে এবং ঔষধের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে হবে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন রকম থেরাপি যেমন, বিহেভিয়ার থেরাপি, সামাজিক দক্ষতার ট্রেনিং ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন, পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাদ্য নিয়ন্ত্রন সবসময়ই সু-স্বাস্থের নিশ্চয়তা দেয়।
বাচ্চাদের হাইপারঅ্যাকটিভিটি বা ADHD আছে সেই বাবা-মায়েদের কিছু জিনিস অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, যেমন সন্তানের এডিএইচডি এবং অন্য যে কোন সমস্যার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে, বাচ্চার স্কুল ও কেয়ার গিভারদের এই সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, বাচ্চার কোন ঔষধ নিয়মিত চললে সেটির সাইড ইফেক্ট সম্পর্কে জানা থাকতে হবে, পরিবার পরিজন এবং আশেপাশের মানুষজনকে এডিএইচডি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে।
ছবিঃ সাটারস্টক।