আয়রন মানব শরীরের জন্য একটু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। এটি মানব শরীরের হিমোগ্লোবিন বা লোহিত রক্ত কণিকা তৈরির কাঁচামাল। আজকাল প্রায়ই শোনা যায় শরীরে রক্তস্বল্পতার সমস্যার কথা, অনেকেই রক্তস্বল্পতা সহ চুল, ত্বক, নখের সমস্যাতেও ভুগে থাকেন। রক্তস্বল্পতার প্রধান কারণই কিন্তু আয়রনের ঘাটতি। দেহে এর ঘাটতি হলে তাকে অ্যানিমিয়া বলে, অর্থাৎ রক্তস্বল্পতা। এর ঘাটতির ফলে শরীরের টিস্যু ও পেশিগুলোতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। তাছাড়া এর প্রভাব পরে মানবদেহের ত্বক, চুল, নখ ইত্যাদিতে। আয়রন ডিফেসেন্সি হলে কোন লক্ষনগুলো দেখে বুঝবেন তাই আজকে শেয়ার করব।
আয়রন ঘাটতির কারণগুলো কী হতে পারে?
এই উপাদান সমৃদ্ধ খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমানে খাদ্য তালিকায় না রাখা হতে পারে অন্যতম একটি বড় কারণ। অনেক সময়েই খাদ্যতালিকায় এ ধরনের খাবার সঠিক পরিমানে রাখা হচ্ছে কি না তা আমলে নেন না অনেকেই, ফলে দেখা দেয় আয়রন ঘাটতি।
শরীরে আয়রনের চাহিদা বাড়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বা দুগ্ধ দানকারী মায়ের ক্ষেত্র, তখন বাড়তি আয়রনের প্রয়োজন হয়। সেই সময় সঠিক ডায়েট ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ না করলে দেখা দেয় ঘাটতি। নারীর গর্ভধারণের সময়টাতে আয়রনের ঘাটতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। গর্ভাবস্থায় ২০ শতাংশ নারীই আয়রনের ঘাটতির ফলে অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকে।
এছাড়াও বিভিন্ন রোগ যেমন, পরিপাকতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ সিলিয়াক ডিজিজ, দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নেওয়া, পাকস্থলীর সার্জারির পর, অর্শ বা পাইলস, কৃমি সংক্রমণ, দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ সেবন এবং রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেলেও দেখা দিতে পারে আয়রনের ঘাটতি।
আয়রন ডিফেসেন্সি হলে কোন লক্ষণগুলো দেখে বুঝবেন?
শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়া
সময়মতো খাবার ও ঘুম হওয়া সত্ত্বেও, আয়রন ঘাটতির ফলে শরীর হঠাৎ করেই দুর্বল অনুভব হয় এবং সারাদিন ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত লাগে।
অতিরিক্ত চুল পড়া
আয়রন ঘাটতির ফলে আগের তুলনায় অধিক চুল ঝড়ে পড়া পরিলক্ষিত হয় এবং সেই সাথে চুল বেশ রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে যায়।
নখ ভেঙ্গে যাওয়া
ইদানিং কি প্রায়ই নখ বারবার ভেঙ্গে যাচ্ছে বা নরম মনে হচ্ছে? তবে বুঝে নিতে হবে যে শরীরে আয়রনের ঘাটতি হচ্ছে।
মাথা ব্যথা বা মাথা ঘুরানো
প্রায়শই মাথা ব্যথা অথবা মাথা ঘোরাচ্ছে? এটিও কিন্তু আয়রন ঘাটতির একটি লক্ষন। শরীরে এর পরিমাণ কম হলে মস্তিষ্ক সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। আর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাবেই দেখা দেয় মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, শারীরিক অস্বস্তি। এমনকি ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে মহিলাদের মধ্যে মাইগ্রেনের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
ডার্ক সার্কেল পড়ে যাওয়া
কোনো কারন ছাড়াই চোখের নিচে কালো দাগ বা ডার্ক সার্কেল পড়েছে? এমনকি পর্যাপ্ত ঘুম ও চোখের উপর অতিরিক্ত প্রেশার পড়ে এমন কাজ না করেও? তবে হয়তো শরীর আয়রন ঘাটতির ব্যাপার জানান দিচ্ছে আপনাকে।
ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
মুখে, চোখে ফ্যাকাসে ভাব দেখা দেয়া। ত্বকের জেল্লা হারিয়ে যাওয়া, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া এবং শুষ্কতা থেকে চুলকানো বা ইচিং, এই ধরনের লক্ষণগুলো শরীরে নিয়মিত দেখা দিলে বুঝতে হবে এটি কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি নয় বরং হতে পারে রক্তস্বল্পতা।
শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া
এর অভাবে শরীরের সব অংশে অপর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের কারনে বুকে ব্যথা অনুভব হয়। যার ফলে শ্বাস নিতেও অসুবিধা হয়। আর তাই উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদ্রোগ সংক্রান্ত কোনও সমস্যা না থাকলেও প্রায়শই বুকে ব্যথা কিন্তু আয়রনের অভাবেও হতে পারে।
হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
হঠাৎ জিভ ফুলে যাচ্ছে অথবা হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার সমস্যায় ভুগছেন, ঠান্ডাজনিত কারন ছাড়াও ঘনঘন জ্বর আসা কিন্তু এর কারণ হতে পারে।
আয়রন ঘাটতি প্রতিরোধে খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন যে খাদ্য গুলো
এর ঘাটতি খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায় খাদ্যের মাধ্যমে। আয়রন সমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ খাদ্যের মধ্যে আছে কচুশাক, পালংশাক, সবুজ শাকসবজি, ব্রকলি, কুমড়োর বীজ, ডাল, বিভিন্ন ড্রাই ফ্রুটস(কিসমিস,এপ্রিকট), বাদাম, কলা, আপেল প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় যুক্ত করতে হবে।
প্রানিজ খাদ্যের মধ্যে কলিজা, হাঁস মুরগীর মাংস, টুনা মাছ, লাল মাংস এগুলোতে আয়রন আছে ভালো পরিমানে। ভিটামিন সি মানবদেহে সহজে আয়রন পরিশোষনের জন্য অপরিহার্য। তাই ভিটামিন সি যুক্ত খাদ্যগুলোও রাখতে হবে খাদ্যতালিকায় প্রত্যহ।
খাদ্যের মাধ্যমেই সহজে আয়রন ঘাটতি পূরন সম্ভব হয়। এছাড়াও ডাক্তারের পরামর্শে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহন করে যাবে। তাছাড়া, কৃমিনাশক ওষুধ খেতে হবে নিয়ম মেনে। গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধ ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের ক্ষেত্রে মাঝে অন্তত ১-২ ঘন্টার বিরতি রাখতে হবে।
শরীরে যদি আয়রন ডিফেসেন্সি বেশি পরিমানে দেখা দেয় এবং সেখান থেকে যদি রক্তশুন্যতা হয়ে যায় তবে আয়রন সমৃদ্ধ খাদ্য নিয়মিত গ্রহনের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শে প্রেসক্রাইব করা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। প্রেসক্রাইব সাপ্লিমেন্ট ছাড়া নিজে থেকে কখনো আয়রন সাপ্লিমেন্ট কিনে গ্রহণ করা যাবে না। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট নিতে হবে ঘাটতির পরিমান বেশি হলে।
ছবি- সাটারস্টক।