এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন? ডেইলি রুটিন টা কি? সকালে রুটি সবজি খেয়ে বের হয়ে যাওয়া, ৩-৪ টা কোচিং, স্কুল কলেজের ক্লাস, সময় পেলে ক্লাসের ফাঁকে এক গাদা বাসা থেকে নিয়ে আসা ম্যাগি নুডলস বা দুটো সিঙ্গারা আর একটা পেপসি… ভর সন্ধ্যায় বাসায় এসেই এক প্লেট ভাত সাথে একটু তরকারি… অথবা সন্ধ্যার নাস্তায় আবার পুরি, সমুচা… না থাকলে নুডলস তো আছেই! এরপর আবার ঘরে ঢুকে পরদিনের পড়া রেডি করা… রাতে আবার এক প্লেট ভাত খেয়ে ঘুমানো…!!
হাই স্কুল আর কলেজের দিনগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের তো এভাবেই কাটে, তাই না? কিন্তু হঠাৎ একদিন মা বা খালা বলে বসলো… “এতো কম বয়সে পেটের এই অবস্থা কেন? ২ বাচ্চার পড়েও তো আমাদের এই দশা হয় নি!”
মনটাই খারাপ হয়ে গেল! নিজেদের মেয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? এরপর একদিন শপিং-এ গেলেন-
দোকানদার ১৭ বছরের আপনাকে ডাকল আন্টি আর আপনার ফ্রেন্ড কে ডাকল আপ্পি!!
[picture]
এমন কেন হল?
অবাক হয়ে বুঝতে চাইলেন … ওয়েট মাপার মেশিনে ওঠার দরকার বা অভ্যাস জীবনেও ছিল না। তাই খুঁজে পেতে একটা মেশিন বের করে ওজন মাপতে গিয়ে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো!! একি…! ১৫ কেজি ওজন বাড়লো কখন?
যাকগে, বেড়েছে বেড়েছে… আর বাড়তে দেবেন না। পেপারে দেখেছেন ডেইলি ৯০০-১২০০ ক্যালরি খেলেই ওজন কমে যাবে। ফেসবুকে গ্রুপ দেখে, নিউজ পোর্টালের ডায়েট চার্ট দেখে… নতুন একটা ডেইলি রুটিন বানালেন আপনি… সেটা দেখতে কেমন হবে একটু দেখি?
সকালে উঠেই বের হয়ে যাবেন… সপ্তাহে ১-২ দিন ব্রেকফাস্ট করবেন, নইলে নেই! স্কুলে/কলেজে গিয়ে একটা সিঙ্গারা খেয়ে নেবেন! লাঞ্চে হয়তো একটু নুডলস খেলেন। বাসায় এসে সন্ধ্যার নাস্তা খাবেন। মা বাবা সাধ্য সাধনা করলে একটু ভাত খাবেন হয়তো… এভাবে ৭-৮ দিন যাওয়ার পর হাঁপিয়ে যাবেন। অনেক হয়েছে! একটু খেলে কি হয়?এবার একটু খাই… একটু খাওয়ার নামে হয়তো পরপর ২-৩ দিন মেয়নেজে চপচপে বার্গার আর পিজ্জার মেলা বসে যাবে, কোক পেপসি তো থাকবে অফুরন্ত!
এরপর থেকে আবার ৭-৮ দিন না খেয়ে থাকা ২-৩ দিনে বার্গার, পিজ্জা, বিরিয়ানির স্রোতে ভেসে যাওয়ার চক্র শুরু হবে।
এরপর কি হবে জানেন?
– সন্ধায় পড়তে বসতে গেলেই শুরু হবে মাথা ব্যাথা! ১ ঘণ্টা পর বইয়ের দিকে তাকাতেই পারবেন না। দেখা গেল সপ্তাহে ৩ দিন রাতে রুমের লাইট বন্ধ করে শুয়ে থাকতে হচ্ছে মাথা ব্যাথা কমাতে। পড়াশোনা উঠছে শিকেয়!
– সকাল ১১-১২ টার দিকে মাথা ঘুরতে শুরু হবে! সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে মনে হবে পা সিসের মতো ভারী।
– আর ২-৩ টার দিকে প্রচণ্ড পেট ব্যথা… বাজে ভাবে পেট কামড়াবে।
কিন্তু আপনি চেপে বসে থাকবেন… এসব আর কি? না খেয়ে থাকলে একটু টায়ার্ড লাগেই! ডায়েট করতে গেলে একটু সহ্য করতে হয়… সহ্য না করলে আগের ফিগার ফেরত পাবেন কিভাবে? সবাইকে দেখিয়ে দিতে হবে না? যে আপনিও পারেন?
যে কজন এই লেখাটা পড়ছেন তার ভেতরে কয়েক হাজার পাঠক কারেন্টলি এই “ডায়েট”-এর সাইকেলে আছেন… তাই না?
আপনাকে জিজ্ঞেস করছি- ডায়েট বলতে কি বোঝেন? একটু ভাবুন তো… ডায়েট মানে কি ওজন কমানোর জন্য বা বাড়ানোর জন্য না খেয়ে থাকা? বা মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া? নাকি অভিধানিক অর্থটাও একটু দেখব?
বেঁচে থাকার জন্য রোজ আপনি যা কিছু খান তার সব কিছু মিলিয়েই ডায়েট, আর কোন বিশেষ কারণে একটি নির্দিষ্ট ধরনের বা রকমের অথবা পরিমাণের খাবার খাওয়া হলে সেটা হবে- ‘ডায়েট কনট্রোল’।
তো কনট্রোল টা করবেন কিভাবে? আপনি কি টিন এজ-এ নিজের দেহের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান এবং সেসব উপাদান কোন কোন খাবারে পাওয়া যাবে ঠিকমতো জানেন? নাকি কনট্রোল করার ‘চার্ট’ নিজে বানিয়েছেন? বা ফেসবুকের কোন এক আপুকে দেখে দেখে করছেন?
থাক চার্টের বিষয়টা নিয়ে পড়ের পর্বেই না হয় কথা বলি… এই পর্বে বরং আরও একটু ভয় দেখাই… টিন এজার পাঠকরা ডানে বায়ে না তাকিয়েই একটা ‘চার্ট’ পেয়ে সেটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেন? না বুঝে শুনে ১৫-১৬ বছর বয়সে ‘ডায়েট কনট্রোল’ নামক সেলফ টর্চারের রেজাল্ট কি হতে পারে? ফলাফল গুলো হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা আর একবার একটা বড় অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেলে সেটা থেকে কখনো উদ্ধার পাওয়া যাবে কিনা এসব আপাতদৃষ্টিতে ‘ফালতু’ ব্যাপারগুলো নিয়ে কখনো ভেবেছেন?
এগুলো নিয়েই এখন একটু বলি?
মাথা ধরা, টায়ার্ড লাগা, পেটে ব্যথা… ডায়েটের এসব সাইড ইফেক্টের মিনিং কি?
– রোজ মাথা ধরে? লাইট সহ্য হয় না? এমনটা হলে প্রথমেই চোখের পাওয়ার চেক করুন। নইলে যতদিনে সবকিছু ব্লার দেখতে শুরু করবেন ততদিনে চোখের নিচ থেকে গালের মাঝ পর্যন্ত ডার্ক সার্কেলও হবে।
– আরও একটা কথা, ডেইলি টেনেটুনে ৪ গ্লাস মতো পানি খান ? কিন্তু ২-৩ বোতল পেপসি খেয়ে ফেলছেন? অতিরিক্ত চিনি দেহের পানির ভারসাম্য নষ্ট করে। একই সমস্যা ফাস্ট ফুড-এর অতিরিক্ত সয়া সস এবং টেস্টিং সল্ট থেকেও হয়। টেনশন নেই! দেশের ১০০% হোটেল রেস্টুরেন্ট-এ এগুলো ছাড়া কিছুই বানানো হয় না। তাই পালিয়ে বাঁচার চিন্তা করলে ভুলে যান,সম্ভব না!
– এছাড়া কোল্ড ড্রিংকস এবং কাপের পর কাপ চা কফিতে থাকা হিসাবছাড়া ক্যাফেইন দেহের পানি কমিয়ে কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। শরীরে পানি কমে গেলে মস্তিষ্কের রক্তচলাচলে সমস্যা হয়। এথেকেও প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা হতে পারে।
তাই, কি বুঝলাম? দীর্ঘদিন ধরে মাথা ব্যথায় ভুগছেন? চোখের সমস্যা (যেটা পারিপার্শ্বিক বা পুষ্টিতে ‘ডায়েট’ করতে গিয়ে যে ঘাটতি করছেন দুই থেকেই হতে পারে) আর শরীরের পানির ভারসম্য নষ্ট হওয়া- দুই দিকই কনসিডার করুন।
– রোজ বিকেলের দিকে প্রচণ্ড টায়ার্ড লাগে? মাথা ঘোরে? সিঁড়ি বাইতে পারেন না? বেশি হাটতে পারেন না? অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। ক্যালরি মেপে ডায়েট করতে গিয়ে পুষ্টি যদি শিকেয় ওঠে তখন শরীর চালাতে যে রক্ত মাংস এসব লাগে তা টিন এজ-এ খেয়ালই থাকে না অনেকের। দেহে ঠিকভাবে রক্ত তৈরি করতে কতটুকু আয়রন ডেইলি লাগে সেটা জানেন? আয়রন কিসে থাকে সেটা জানেন? ম্যাগি নুডলস খেয়ে ডায়েট করে এই আয়রন, ক্যালসিয়াম , ভিটামিন সি-এর ঘাটতি পূরণ করা কোনভাবেই সম্ভব নয় পাঠক!
– তাই, অতিসত্বর চেক করুন ম্যালনিউট্রিশন-এ ভুগছেন কিনা। টিন এজার-দের মা বাবা এই লেখা পড়ে থাকলে তাদেরও বলছি, বাচ্চা ক্লান্ত হয়ে গেলে প্লেটে আরও এক গামলা ভাত ঢেলে দিয়ে দায়িত্ব পূরণের চিন্তা ভুলেও করবেন না। অবশ্যই ডাক্তারের কাছে নেবেন!
– রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া, হিমগ্লোবিন কমে যাওয়া- এসব সমস্যায় অনেক দিন ভুগলে বর্তমানে কোমর সমান চুল মুহূর্তে কমে মাথায় টাক পড়ে যাওয়া, স্কিন নষ্ট হওয়া এসব সমস্যায় তো ভুগবেনই… হাজার টন ক্যাস্টর ওয়েল আর ক্রিম ঘসেও সেই গ্লো আর চুল ফেরত পাবেন না। এছাড়াও ভবিষ্যতে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা, হাড়ের সমস্যা, প্রেগ্ন্যান্সি-এর ক্ষেত্রে বাচ্চা আর মা দুইয়েরই প্রাণ সংশয় ! এসব তো আছেই!
দেশের মোট টিন এজ মেয়েদের ভেতরে ৪৩% রক্তশূন্যতায় ভোগে!! জানেন এটা? আপনার যে এই প্রবলেম নেই কিভাবে বুঝবেন? আর প্রবলেম পুষে পুষে ভবিষ্যতে প্রান নিয়ে টানাটানি পড়লে?
কি করবেন তখন? ডাক্তারের উপরে দোষ চাপিয়ে দেবেন?
– না খেয়ে ২-৩ ঘণ্টা থাকলেই পেটে ব্যথা শুরু হয়? যত দিন যাচ্ছে ততই এই ব্যথা বাড়ছে? কাউকে কি বলে দিতে হবে এটা কিসের সিম্পটম? অবশ্যই না! অ্যাসিডিটি গ্যাসট্রিক ছাড়া টিন এজার কটা আছে বাকি এদেশে? বয়স ১৪-১৫ হয়ে গেলেই ডায়েট আর ফাস্ট ফুডের অত্যাচারে অ্যাসিডিটি বানিয়ে ফেলাটা এখনতো ডাল ভাত! রাইট?
– অ্যাসিডিটি কি এমন পর্যায়ে নেবার ইচ্ছা আছে যেখানে ১ ঘণ্টা পরপর কিছু খাওয়ার কথা ডাক্তারের ধমক দিয়ে বলবে? নইলে পেটের ব্যথায় মরে যেতে ইচ্ছা হবে? লেবু, ভিনেগার , চা খেলে বুক জ্বালাপোড়ায় সারাটা দিন নড়তে পারবেন না?
– একটা মজার বিষয় কি জানেন? এই যে ডায়েট করতে গিয়ে যেসব টিন এজার-রা অ্যাসিডিটি বানায়, তারা কিন্তু ফিউচারে চাইলেও ডায়েট করতে পারবে না!! ওজন যতই বাড়ুক, কোনভাবেই লেবু পানি, গ্রিন টি এসব ছুঁতেও পারবেন না। তাই একইসাথে কিন্তু আপনি আপনার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দুইয়ের পায়েই কুড়াল মেরে বসে আছেন!
– আরও মজার ব্যাপার কি জানেন? গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটি প্রবলেম একবার হয়ে গেলে এটার হাত থেকে আর কোনভাবেই মুক্তি পাবেন না! এর উপরে জোর করে ডায়েট করতে চাইছেন? আলসার, পেপটিক আলসারে পাকস্থলী ফুটো হয়ে যাবার প্রস্তুতি এখনি নিয়ে রাখুন!
তাই অলরেডি অ্যাসিডিটি বাঁধিয়ে ফেলেছেন? সুস্থ শরীর থাকলে কেমন লাগে সেটা স্মৃতির পাতা ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাবেন না !
– আরও একটা বুড়োটে ‘ফালতু’ কথা… এক্সসেসিভ সুগার, প্রসেসড ফুড (প্যাকেটে করে বিক্রি হয় এমন সবকিছুই প্রসেসড), অতিরিক্ত সাদা কার্বোহাইড্রেট যেমন পাউরুটি, সাদা ভাত, রেড মিট (অতিরিক্ত গরুর মাংস)… ভবিষ্যতে কি তৈরি করতে পারে জানেন? ডায়াবেটিস! জানেন কিনা জানি না, এই রোগের হাত থেকেও কিন্তু কোন মুক্তি নেই…ধারণা করা হচ্ছে ২০৪০ সালের ভেতরে দেশে ১.৩ কোটির মতো টিন এজ ডায়াবেটিস পেশেনট থাকবে! তাই অযথা নিজেকে রিস্কে ফেলবেন কিনা সেসব খুব ভালোভাবে চিন্তা করবেন, ঠিক আছে?
ব্যস, এই পর্বে যথেষ্ট ভয় দেখালাম। দুঃখজনক হলেও, সত্যি সবসময় এমনটাই হয়। আশা করি ‘ডায়েট’-এর নামে টিন এজ আপনি, বা বয়স্ক হলে আপনার বাচ্চা কি প্র্যাকটিস করছে তা নিয়ে খুব গভীর ভাবে চিন্তা করবেন। স্বাস্থ্যই সম্পদ… এই কথাটা যেন রোগে শোকে ভুগে মনের শান্তি আর টাকা দুইয়েরই জলাঞ্জলি দেবার পড়ে মনে না পড়ে!
পরবর্তী পর্বেই টিন এজারদের ডেইলি কোন পুষ্টি কতটুকু লাগে তার চার্ট সাথে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার খুবই স্বাস্থ্যকর কিছু উপায় নিয়ে লিখব। যাতে স্কুল কলেজ গোয়ার-রাও হাজার ব্যস্ততায়ও দরকারি খাবারটুকু পায়!
আপাতত, দাঁত থাকা অবস্থাতেই দাঁতের মর্ম বোঝার একটু চেষ্টা অন্তত করুন।
লিখেছেন- তাবাসসুম মীম