ফরিদা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত ব্যথা অনুভব করেন। ঘুমের মধ্যে হাত ঠিকমতো রাখেননি, তাই এমন হচ্ছে ভেবে সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকেন। রাতে ঘুমানোর সময় লক্ষ্য করে হাতের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠেছে। ব্যথা ধীরে ধীরে আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কী চিকিৎসা নিবেন, কার কাছে যাবেন ভাবতে ভাবতে কয়েকদিনের মধ্যে ব্যথা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, তিনি কোনো ভারী কাজ আর করতে পারেন না, হাতের মুঠোয় শক্ত করে কিছু ধরাই প্রায় অসম্ভব! কনুইয়ের হাড়ে এ ধরনের ব্যথা হওয়া, কনুইয়ে ভর দিতে না পারা, হাত মুঠো করতে না পারা, ভেজা কাপড় নিংড়াতে না পারা বা রুটি বেলতে না পারা, এ সবই ‘টেনিস এলবো’-এর লক্ষণ হতে পারে। চলুন বিস্তারিত জেনে নেই টেনিস এলবো নিয়ে।
টেনিস এলবো কী?
টেনিস এলবো সাধারণ অর্থোপেডিক কন্ডিশন (ডাক্তারি পরিভাষায় Lateral Epicondylitis) যা কনুইয়ের অস্থিসন্ধির একটি ব্যথার ধরন। টেনিস খেলোয়াড়দের এই সমস্যা বেশি দেখা দেয়, তাই একে টেনিস এলবো বলা হয়। তবে শুধু টেনিস খেলোয়াড়দেরই নয়, এই সমস্যা অন্য খেলোয়াড়দেরও দেখা যায়। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, গলফ ইত্যাদি স্পোর্টস অ্যাকটিভিটিসেও ভুল পন্থা অবলম্বনের কারণে এই ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক খেলোয়াড়দেরকেই এই সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন যাবত খেলাধুলার বাইরে থাকতে হয়, খেয়াল করে দেখেছেন নিশ্চয়ই। তাছাড়া একটানা কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয় এমন চাকুরীজীবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, গৃহিণী, অর্থাৎ যাদের হাতের কাজ বেশি করতে হয়, তাদেরও এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কেন হয় এই ব্যথা?
চলুন আজ এর কিছু সাধারণ কারণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে জেনে নেই।
১. হাতের অতিরিক্ত ব্যবহার
টেনিস এলবো মূলত কনুইয়ের মাংসপেশি ও টেন্ডনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে হয়। যেসব কাজে হাতের কব্জির ব্যবহার বেশি, যেমন- টেনিস, চিত্রশিল্প, টাইপ করা, এগুলো টেনিস এলবো হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
২. বয়স
টেনিস এলবো মোটামুটি ৩০ থেকে ৫০ বছরের বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি দেখা দেয়। যদিও এটি সব বয়সের নারী-পুরুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
৩. পেশাগত কারণ
এমন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি, যার হাতের একই কাজ পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তাদের ক্ষেত্রে টেনিস এলবো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কীভাবে বুঝবেন আপনি এই রোগে আক্রান্ত?
- এই সমস্যার শুরুতে হাতের কনুইয়ের বাইরের দিকে ব্যথা অনুভব হয়
- হাতের নাড়াচাড়া বা কাজকর্মের কারণে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে
- ব্যথা কনুই থেকে শুরু হয়ে হাতের বাইরের পাশ দিয়ে আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে
- অনেক সময় রোগী হাতের জয়েন্টের ভেতর ব্যথা অনুভব করে
- কনুইয়ের বাইরের দিকে চাপ দিলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়
- দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে হাতের কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়
টেনিস এলবো কি পুরোপুরি ঠিক হয়?
এই রোগ পুরোপুরি ঠিক হয় না। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হুটহাট ব্যথার ওষুধ খেলে বা ইনজেকশন নিলে হিতে বিপরীত হতে পারে! নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে টেনিস এলবোর ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এই জাতীয় লক্ষণ প্রকাশ পেলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা গ্রহণ করলে নিয়মিত থেরাপির মাধ্যমে এই সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
প্রতিরোধ কীভাবে করবেন?
টেনিস এলবো প্রতিরোধ করতে চাইলে যে সব নিয়ম মেনে চলতে হবে-
১) নিয়মিত খেলা বা দৈনন্দিন যে কাজের জন্য এই ব্যথা হতে পারে, সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে কিংবা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২) শারীরিকভাবে ফিট থাকার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। আপনার ফিটনেস রুটিনে হাতের মাংসপেশি শক্তিশালী করার জন্য ব্যায়াম রাখতে পারেন।
৩) পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। এতে মাংসপেশি ও টেন্ডনের সঠিক পরিচর্যা হবে এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ সহ্য করতে পারবে।
৪) আপনার ওয়ার্ক স্টেশনে কাজ করার সময় কনুই ও হাতের মাংসপেশিতে চাপ যেন না পরে সেভাবে সেটআপ করে নিতে হবে।
টেনিস এলবোর সাধারণ লক্ষণ দেখা দিলেই ব্যথা ইগনোর না করে সঠিক চিকিৎসা নিন, নিয়মমতো ব্যায়াম করুন। শুরু থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারলে বড় রকমের জটিলতা এড়ানো যায়। সচেতন হন, সুস্থ থাকুন।
লিখেছেন- মাহমুদা আক্তার রোজী, জেরিয়াট্রিক ফিজিওথেরাপিস্ট
ছবি- সাটারস্টক