গল্পটা বোধয় এমনই হবার ছিল। গত ১০ বছর ধরে আমরা একজন আরেকজনের পাশে ছিলাম, কিন্তু কবে যেন শুধু পাশেই থেকে গেলাম, সাথে আর থাকতে পারলাম না। দীর্ঘদিনের অভ্যাসগুলো ছুটে গেল। ডেসটিনেশন এক হলেও আমাদের চলার রাস্তা ভিন্ন ছিল। কবে যেন সুরটা কেটে গেলো। অবশেষে বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে শুরু করলাম দুজনেই।
উপরের গল্পটা পরিচিত মনে হচ্ছে? এটা কিন্তু আপনার – আমার জীবনেরই গল্প, চারপাশে তাকালেই এ গল্পটা দেখতে পাবেন। সেপারেশন বা ডিভোর্সের পরের সময়টা সাবেক স্বামী এবং স্ত্রীটির জন্য কিন্তু ভীষণ কঠিন। ডিভোর্স মিউচুয়ালি হোক, আর কাদা ছোঁড়াছুড়ি করেই হোক না কেন, কষ্ট কিন্তু দুজনেরই হয়। আর যদি সেই সাবেক হয়ে যাওয়া দম্পতিটির সন্তান থাকে, তাহলে উভয়ের জন্য এবং সন্তানের জন্য ও এই ট্রান্সিশনের সময়টা পার করা খুব কঠিন। কারণ যাই হোক না কেন, পথ তো আলাদা হয়ে গিয়েছে। জীবন তো আর থেমে থাকে না।
যেসব নারীরা হাউসওয়াইফ ছিলেন, তাদের জন্য এ সময়টা আরও কঠিন। সমাজে মাথা উঁচু করে চলার জন্য আর্থিক সচ্ছলতা যে কতটা দরকার সেটা ভুক্তভোগীরাই জানেন, বিশেষ করে আপনাকে যদি একা পথ চলতে হয়। আমার আজকের লেখাটি সেই নারীদের জন্য যারা জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পা রেখেছেন।
[picture]
মেয়েদের জন্য যে শিক্ষিত হওয়াটা কতটা জরুরী সেটা তো আসলে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই আপনার শিক্ষা আপনাকে পথ চলতে সহায়তা করবে, হোঁচট খাওয়া থেকে রক্ষা করবে। আমার পরিচিত অনেক মেয়েকেই দেখেছি বিয়ের পরপর পড়ালেখা ছেড়ে দেন, ভাবেন যে সংসারে ডেডিকেশন দেয়ার জন্য পড়ালেখা নিয়ে সময় নষ্ট না করাই ভালো। শুনতে খুব খারাপ শোনালেও এই মেয়েগুলো পরবর্তী জীবনে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খান। যারা বিয়ের আগে থেকে চাকরী বা ব্যবসা করতেন, তারাও অনেকে সংসারের ব্যস্ততায় সেটা বন্ধ করে দেন। ধাক্কা তারাও খান। আর্থিক স্বাবলম্বীতা পথ চলার জন্য ভীষণ জরুরী। যতদিনে এটা বুঝতে পারেন, ততদিনে আসলে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। আমি বলছি না যে আপনাকে চাকরীই করতে হবে। আপনার নিজের যে কাজটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ, যেটায় আপনি বেশ পারদর্শি সেটাই করুন। আপনার আয় ও হবে, আপনি ব্যস্ত ও থাকবেন, এবং আপনার মন ও ভালো থাকবে। আর পথ চলতে চলতে যদি হোঁচট খেতে হয়, তাহলে পরে যাবেন না। ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন, আপনার যদি গ্রাফিক্সের কাজ জানা থাকে, যদি ফটোগ্রাফি জানা থাকে তাহলে অনায়াসেই সেটা করতে পারেন। যদি রান্নায় পারদর্শি হন, বাসায় থেকেই খাবারের বিজনেস স্টার্ট করতে পারেন। যদি ক্রাফটিং, ছবি আঁকা, মেকআপ, এ জাতীয় কাজে আগ্রহ থাকে সেটাও শুরু করতে পারেন। বেকিং এ আগ্রহ থাকলে বাসায় বসেই কেক তৈরির বিজনেস স্টার্ট করতে পারেন। এছাড়াও স্টার্ট আপের অনেক আইডিয়া আছে। আপনি যেটায় পারদর্শি এবং সুযোগ পাবেন সেটাই করুন। আর সবচেয়ে বড় কথা পড়াশোনা বন্ধ করবেন না।
সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্বের জন্য বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য সহযোগী রাখুন। আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিন, সেটা না সম্ভব হলে মেইড রাখতে পারেন, আর ডেকেয়ারের অপশন তো আছেই। যদিও আমাদের দেশে এখনো মানসম্মত ডেকেয়ারের খুবই অভাব। সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিন। তাকে নিয়ে বেড়াতে যান। ধীরে ধীরে তাকে আপনাদের জীবনের এই ট্রান্সিশনের ব্যাপারে বুঝিয়ে বলুন। আর একটা জিনিস কখনোই করবেন না, সেটা হচ্ছে প্যারেন্ট সম্পর্কে নেগেটিভ কথা। আপনার জীবনসঙ্গী এখন আর আপনার সাথে পথ না চললেও সে আপনার সন্তানের প্যারেন্ট, সেটা সে আজীবনই থেকে যাবে। আর আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার সন্তান তার প্যারেন্টস সম্পর্কে কোন প্রকার নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বড় হোক। এটা সন্তানদের মানসিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
নিজেকে ভালোবাসুন। নিজের ভালো লাগে এমন কাজগুলো করুন। জীবন কিন্তু সবাইকে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার সুযোগ দেয় না। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। নিজেকে যোগ্য করে তুলুন। আর বলুন – I am not vulnerable. And I refuse to be a victim.
ছবি – ফটোগ্রাফারস ডট ক্যানেভেরা
লিখেছেন – ফারহানা প্রীতি