সবসময় কি আর একঘেয়ে সাজ ভালো লাগে? কানের দুল, কপালের ছোট্ট টিপের পাশাপাশি একটু রিনিঝিনি শব্দে না হয় হাত দুটোও সাজিয়ে নেই, আর এর জন্য একগুচ্ছ চুড়ির কোনো তুলনা হয় না। আবার বাইরে হুটহাট বের হতে গেলে কিংবা যে কোন জায়গায়, হালকা সাজতে চাইলে চট করে মানানসই এক মুঠো চুড়ি পরে নেয়া যায়!
বাঙালি নারীর সাজের একটি অনুসঙ্গ হলো দু’হাত ভর্তি চুড়ি, বিশেষ করে রিনিঝিনি শব্দ তোলা কাঁচের চুড়ি। নারীদের এক অনন্য অলঙ্কার হচ্ছে চুড়ি। বাংলার নারীদের কাছে চুড়ির কদর সেই প্রাচীনকাল থেকে। সাজগোজের সময় দুহাত ভর্তি করে চুড়ি না পরতে পারলে সাজটাই যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আর বিশেষ করে যেকোন উৎসব আয়োজনের দিন জমকালো সাজের সঙ্গে একগুচ্ছ চুড়ি যেন না পরলেই নয়!
তবে চুড়ির সেই রিনিঝিনি শব্দ কমে গেছে অনেক, কাঁচের চুড়ির মন্ত্রমুগ্ধ রিনিঝিনি শহুরের যান্ত্রিক জীবনকে আর ছোঁয় না। কাঁচের জায়গা দখল করে নিয়েছে মেটাল, প্লাস্টিক বা অন্য উপকরণ। যদিও এই কাচের চুড়ির রয়েছে ১০০ বছরেরও পুরনো ইতিহাস।
অতীতে চুড়ির ইতিহাসঃ
আগে সম্ভ্রান্ত জমিদার ও নবাব পরিবারের নারীদের হাতে রেশমি চুড়ি থাকাটা ছিল অবধারিত। সে সময় চুড়ি প্রধানত কাঁচ থেকে তৈরি হতো। তবে শামুকের খোল, তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও হাতির দাঁতের চুড়িও তখন ছিল। পাকিস্তানে (যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ২৬শ বছর আগে) পাওয়া এক মূর্তিতে দেখা যায়, নৃত্যরত এক বালিকার বাম হাতে চুড়ি রয়েছে। সম্ভবত তখন দুহাতে চুড়ি পরার সংস্কৃতি ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশে চুড়ি ঠিক কবে চালু হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কারো কাছে নেই। তবে বিভিন্ন প্রত্নতাত্তিক খননকালে খোল, তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও আকিক পাথরের চুড়ি পাওয়া গেছে। মৌর্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ডিজাইনের চুড়ি পাওয়া গেছে ভারতে। হীরা, মূল্যবান পাথর আর মুক্তো বসানো চুড়ির প্রচলন এখনো ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে।
বর্তমান সময়ে চুড়িঃ
নতুন প্রজন্মের নারীদের কাছেও চুড়ি সমানভাবেই সমাদৃত। এখনো অনেক আধুনিক তরুণীদের পছন্দের এক বিশেষ অনুষঙ্গ হচ্ছে কাঁচের চুড়ির। আধুনিকতার ছোঁয়ায়, এখন মানুষের আগ্রহ বেড়েছে নান্দনিকতায়। তাই কাঁচের চুড়িতে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে শিল্পের বাহারি ডিজাইনের ছোঁয়া। যুগ পাল্টেছে আর পাল্টেছে চুড়ির ধরনও। রেশমী চুড়ির পাশাপাশি সমান ভাবে জায়গা করে নিয়েছে চৌকো, ত্রিকোণ, ডিম্বাকৃতির প্লাস্টিক ও মেটাল চুড়ি। মাটি, সুতা, চামড়া, ব্যাকেলাইট, রবার, কাঠ, মাটি, বিডস, পুঁতি, সিটি গোল্ডসহ নানা ধরনের চুড়ির ব্যবহার বাড়ছে। এগুলো চুড়ির বৈচিত্র্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
চুড়ি পরার প্রচলন মূলত শাড়ির সাথে হলেও আজকার সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া, লং স্কার্টের সাথেও তরুণীদের চুড়ি পরার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে সেটা হতে হবে অবশ্যই পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। ওয়েস্টার্ন ড্রেসের সাথেও দু-একটা চুড়ি পরলে আসে অন্যরকম সামঞ্জস্য।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিটি উৎসবেই বাঙালি নারী চুড়ি সাজের জন্য বেছে নিচ্ছে। ছোট বড় যে কোনো বয়সী মেয়েরাই চুড়ি পরছে। ঋতুবৈচিত্র্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চুড়ির রং নির্বাচন করেন বাঙালি নারীরা। আমাদের দেশে বৈশাখে লাল সাদা, বসন্তে লাল-হলুদ, বাসন্তী চুড়ি পরে নারীরা। আবার বিভিন্ন দিবসে যেমন; একুশে সাদা-কালো, বিজয় আর স্বাধীনতা দিবসে লাল-সবুজ রংয়ের চুড়ি হাতে পরে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটায় বাঙালি তরুণীরা।
চুড়ির জন্য খরচা-পাতিঃ
সারা বছরই চুড়ি বিক্রি হয়। রেশমী চুড়ির দাম তুলনামূলক ভাবে কম। একটু ভালো মানের এক ডজন চুড়ির দাম পড়বে ৩০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া রয়েছে জয়পুরী স্টিল-২৮০, সুতি চুড়ি-৭০ টাকা। মুক্তার বালা-স্টোন, গ্লিটার আর মুক্তার সংমিশ্রণে তৈরি। বালাগুলো দেখতে খুব সুন্দর।
জয়পুরী চুড়ির ক্ষেত্রে হালকা মেটাল, কাঁচ ও মাটির মিশ্রণে তৈরি চুড়িগুলো এখন অনেক জনপ্রিয়। নকশাভেদে এসব চুড়ির দাম পড়বে প্রতি জোড়া ১৫০-৮০০ টাকা।
মেটালের চুড়ির ক্ষেত্রে মেটালের সেট চুড়িগুলো এক সেট পরলেই হাত ভরে যায়। রঙ, মান এবং নকশার ওপর ভিত্তি করে দাম পড়বে ৪০ থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনে থেকে টিএসসি মোড়, কলা ভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ছবিরহাট, দোয়েল চত্বরে বসে রঙবেরঙের চুড়ির বাজার। সেখানে আরও পাবেন ঢাকাই চুড়ি। এছাড়াও ইডেন কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সামনে, নিউমার্কেট, গাউসিয়া, চাঁদনী চকেও পাওয়া যায় রেশমী চুড়িসহ বাহারি চুড়ির বাজার। শহরের প্রায় সবগুলো মার্কেট ও শপিংমলে পাওয়া যাচ্ছে বাহারী এসব চুড়ি।
এছাড়া আমাদের দেশে বিভিন্ন মেলাতে দেশীয় এবং দেশের বাইরে থেকেও চুড়ি আনা হয় বেচাকেনার জন্য।
চুড়ি থাকলে সাজটাই যেন একটু অন্যরকম সুন্দর হয়ে ওঠে। চুড়ি হাতের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়, সাজগোজে নিয়ে আসে নান্দনিকতা ।
লিখেছেনঃ সোহানা মোরশেদ
ছবিঃ ইমেজবাডি.কম