মাতৃত্বকালীন ছুটি বা ম্যাটারনিটি লিভ যেটাই বলি না কেন, প্রত্যেকটি মায়ের কাছে এই সময়টা খুবই স্পেশাল। বাচ্চা হওয়ার পর মায়েরা আস্তে আস্তে নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বাচ্চার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই আনন্দের। কিন্তু একটা সময় পর একটু মন খারাপ হয়, সাথে টেনশনও হতে থাকে; যখন ক্যালেন্ডারের পাতা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে ছুটি শেষ! এবার কাজে ফিরতে হবে।
‘মা কে ছাড়া বাচ্চা কীভাবে একা থাকবে এতোটা সময়? তার খেয়াল সঠিকভাবে রাখা হবে তো? ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে তো?’ এই প্রশ্নগুলো মনে আসাটা খুবই স্বাভাবিক! নিজের ক্যারিয়ারটা আবার কীভাবে আগের মতো গুছিয়ে নিবো বা কাজে কীভাবে ফোকাস করবো; এসব চিন্তাও মাথায় আসে। এই ধাপটা সব কর্মজীবী মায়েরাই ফেইস করেন। ম্যাটারনিটি লিভ শেষে কাজে ফিরতে নিজেকে প্রস্তুত করবেন কীভাবে, সেটাই জানাবো আজকের ফিচারে।
ম্যাটারনিটি লিভ শেষে কাজে ফেরা
ওয়ার্কিং মাদার বা হাউজ ওয়াইফ মাদার, সব মায়েদেরই নিজস্ব স্ট্রাগল আছে। বেবি হওয়ার পর হরমোনাল ইস্যু, হুটহাট মুড সুইং বা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন এসব ব্যাপার তো আছেই। আর ঘুমের কথা তো বাদই দিলাম। দিনশেষে সন্তান, ক্যারিয়ার, পরিবার সব মিলিয়ে ব্যালেন্স করা সহজ নয়; তবে অসম্ভবও কিছু নয়। এই সময়ে কিছু সিদ্ধান্ত আপনাকে নতুন পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করবে। চলুন দেখে নেই সেগুলো কী।
১) মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন
আগেই বলেছি, নতুন মায়েদের জন্য মুড সুইং খুবই কমন একটা বিষয়। একেক সময় একেক ধরনের চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। একবার মনে হতে পারে যে জবটা ছেড়ে দেই। আবার মনে হবে এতোটা পথ পরিশ্রম করে এসে এখন ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে দিবো কেন! এই সময়ে আপনি গিলটি ফিল করতে পারেন। নিজেকে স্বার্থপরও মনে হতে থাকে। প্রথমেই এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। নিজেকেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আপনি যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হন, তাহলে আপনিও ফ্যামিলিতে কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন। আপনার নিজের জন্য এবং আপনার সন্তানের বেটার ফিউচারের জন্য দু’দিকেই তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুব জরুরি। এই সময়ে হাসবেন্ড ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সাপোর্ট খুবই প্রয়োজন। সবার সাপোর্ট থাকলেও দিনশেষে আপনাকেই কিন্তু স্ট্রং হতে হবে। ক্যারিয়ার আপনার, সন্তান আপনার; তাই সব সিদ্ধান্তই আপনার হাতে।
২) রুটিনে আনুন পরিবর্তন
হঠাৎ করে ডেইলি রুটিনে পরিবর্তন আনা সম্ভব না। অফিস সাধারণত ৯-৫টা হয়ে থাকে। কিন্তু লিভে থাকাকালীন দেখা যায় যে দিনে আপনি কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পান। দিনে বাচ্চা যখন ঘুমায়, তখন মাও সাথে ঘুমাতে পারে বা সংসারের কাজ এগিয়ে রাখতে পারে। অফিস শুরু হলে আবার আপনাকে এই রুটিনে ফিরতে হবে। তাই অফিস শুরু করার আগেই আস্তে আস্তে ঘুমের রুটিন অর্থাৎ লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আনুন। বাচ্চার খাওয়া দাওয়া, গোসল, ঘুম এগুলোও রুটিনের মধ্যে আনুন।
৩) বাচ্চাকে কার কাছে রাখবেন আগেই ঠিক করুন
বাইরের দেশগুলোতে ডে কেয়ার রয়েছে। দেশেও এখন এই সুযোগ অনেক জায়গায় আছে। অনেক অফিসের নিজস্ব ডে কেয়ার থাকে। আমাদের দেশে ম্যাক্সিমাম মায়েরা বাচ্চাকে দাদা, দাদি বা নানা, নানীর কাছে রেখে অফিস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে হুট করে তাদের কাছে রাখলে বাচ্চার অ্যাডজাস্ট করতে বা চিনতে অসুবিধা হয়ে যায়, তাই আগে থেকেই প্র্যাকটিস করুন। ডে কেয়ারে রাখলে প্রথমে অল্প কিছু সময় রেখে অ্যাডজাস্ট করতে দিন, এতে সে চিনতে শিখবে। আপনাকে হুট করে কাছে না পেলে বাচ্চা প্রথম প্রথম কাঁদতে পারে, ঘাবড়াবেন না। কেয়ার গিভার যেন যথেষ্ট কেয়ারিং ও রেসপন্সিবল হন, সেটা ইনশিওর করুন।
৪) ফিডার ফিডিংয়ে অভ্যস্ত করুন
এটা অনেক ইম্পরট্যান্ট একটা বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চার ফিডারে দুধ খাওয়ার অভ্যাসটা হতে অনেক টাইম লাগে। তাই লিভ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ট্রাই করলে আপনি এই ব্যাপারে ব্যর্থ হতে পারেন। তাই এই সময়ের আগেই ব্রেস্টফিডিং এর সাথে সাথে বেবিকে ফিডারে ইউজ টু করুন। এতে আপনি ব্রেস্টমিল্ক পাম্প করে ফিডারে রেখে অফিসে গেলে সেই সময়ে বেবি সেটা খেতে পারবে। তা না হলে পরে আপনারই হ্যাসেল হবে।
৫) নিজের ও বাচ্চার জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখুন
যেহেতু অনেকটা সময় বাচ্চার থেকে আপনি দূরে থাকছেন, তাই আগেই বাচ্চার জামা কাপড় থেকে শুরু করে সব খেলনা, ওয়াটার বোতল ও কসমেটিকস গুছিয়ে ফেলুন। যে বা যারা বাচ্চার সাথে থাকবে, তাদেরকে সব বুঝিয়ে দিন যাতে বাচ্চার খেয়াল রাখতে সমস্যা না হয়। বাচ্চার খাবার নিজে প্রিপেয়ার করে গেলে এয়ার টাইট বক্সে রেখে ফ্রিজে স্টোর করুন। প্রয়োজনে চার্ট তৈরি করুন বাচ্চাকে কখন কোন খাবার দিতে হবে।
আর এ সময়ে যেহেতু মায়ের বডি ওয়েট একটু বেড়ে যায়, তাই অফিসে পরার ড্রেসগুলো লিভ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকঠাক করে রাখুন। ব্যাগে দরকারি জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখুন। নিজের আইডি কার্ড, অফিসিয়াল ডকুমেন্ট জায়গামতো রাখুন। সাথে নিজের খাবারের দিকেও গুরুত্ব দিন। টুকটাক স্ন্যাকস, মিক্সড নাট, কুকিজ এসব আইটেম রাখুন সাথে। কেননা বাচ্চার সাথে সাথে মায়েরও প্রোপার নিউট্রিয়েন্ট ইনটেক জরুরি।
৬) লিভে থাকলেও কলিগদের সাথে যোগাযোগ রাখুন
অনেক দিন পর অফিস যাচ্ছেন, হয়তো প্রথমে একটু অন্য রকম ফিল হতে পারে। কাজের মাঝে লং গ্যাপ থাকলে প্রথম দিকে অ্যাডজাস্ট করতে একটু প্রবলেম হতেই পারে। এজন্য লিভে থাকাকালীন টাইমেও অফিসের কলিগ বা বসের সাথে যোগাযোগ রাখুন। মাঝে মধ্যে টুকটাক খবর রেখে আপ টু ডেট থাকুন, যাতে কাজ গুছিয়ে নিতে সমস্যা না হয়। আরেকটা ব্যাপার, অলওয়েজ ফিল ফ্রি টু শেয়ার এই মেন্টালিটি বজায় রাখুন। কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে বা বুঝতে পারছেন না? কলিগদের সাথে শেয়ার করুন। দেখবেন তখন নিজেরও একটু হালকা লাগবে।
৭) অন্যান্য প্যারেন্টদের সাথে আলোচনা করুন
আপনি যখন আপনার প্রবলেমগুলো অন্যান্য প্যারেন্টদের সাথে শেয়ার করবেন, দেখবেন অনেক প্রবলেমই সল্ভ হয়ে যাচ্ছে বা না হলেও মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে আপনি আসতে পারছেন। সেটা বাচ্চা রিলেটেড হোক বা আপনার নিজের ব্যাপারে। যারা এক্সপেরিয়েন্সড, যারা আপনার এই ধাপ পার করে এসেছেন; তাদের থেকে আপনি বেটার সাজেশন পাবেন। কর্মজীবী মায়েদের সাথে কথা বলুন, তারা কীভাবে সব ম্যানেজ করছে, সেটা জানুন। আপনার নিজেরও হালকা লাগবে এবং সেই সাথে অনেক টিপসও জানা হবে।
জবে জয়েনের পর কীভাবে ম্যানেজ করবেন?
ম্যাটারনিটি লিভ শেষে জবে জয়েন করলে প্রথম প্রথম আপনার কিছুটা ঝামেলা হবে দু’দিক ব্যালেন্স করে চলতে। আপনি পারবেন, অবশ্যই পারবেন। এই বিষয়ে আরেক দিন ডিটেইলসে লিখবো না হয়। আজ বেসিক কিছু টিপস শেয়ার করছি যা আপনার লাইফকে করবে ইজি।
সংসারের কাজ ভাগ করে নিন
১. ছোট বাচ্চা থাকা মানে আপনার বাসা খুব একটা গোছানো বা ছিমছাম থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক! অনেকে এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন, স্পেশালি যারা একটু গোছানো থাকতে পছন্দ করেন। তাই উইকেন্ডে আপনি হেল্পিং হ্যান্ডের সাহায্যে পুরো ঘর ক্লিন করতে পারেন।
২. উইকেন্ডে সেই সপ্তাহের খাবারের মেন্যু ঠিক করে আগে আগেই সব গুছিয়ে রাখতে পারেন। ভেজিটেবল কেটে রাখতে পারেন। চিকেন বা ফিশ রেডি টু কুক করে ডিপে রাখতে পারেন। গার্লিক-জিঞ্জার পেস্ট করে রাখতে পারেন। দেখবেন সপ্তাহের অন্যান্য দিনে হ্যাসেল অনেকটাই কমে গেছে।
৩. বাচ্চার সব খেলনা, কাপড় ক্লিন করে গুছিয়েও রাখতে পারেন ছুটির দিনে। এক্ষেত্রে হাসবেন্ডের হেল্প নিন। সংসারের ছোট খাটো কাজগুলো ভাগ করে নিলে আপনার একার উপর প্রেশার কম পরবে। আর পরিবারের অন্য সদস্যরাও যদি ঘরের কাজে আপনাকে হেল্প করে, তাহলে তো সেটা আপনার জন্য প্লাস পয়েন্ট। তাহলে আপনিও বেবিকে টাইম দিতে পারবেন।
সেলফ প্যাম্পার করতে ভুলবেন না
চেষ্টা করুন মাসে অন্তত একবার উইকেন্ডে একটু ঘুরে আসতে, এতে রিফ্রেশ ফিল করবেন। আর এই সময়ে আসলে “মি টাইম” স্পেন্ড করা পসিবল হয় না। তারপরও ছুটির দিনে অন্তত এক ঘন্টা নিজের জন্য রাখুন। এমন কিছু করুন যেটা ভালো লাগে। একটু বই পড়া বা রূপচর্চা করা বা গার্ডেনিং বা অন্য যে কোনো শখের কাজ। সেলফ প্যাম্পার করলে মানসিকভাবেও আপনি প্রফুল্ল থাকবেন।
মাতৃত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। এই সময়টা উপভোগ করুন প্রাণভরে। সন্তান ও সংসার সামলে নিজের ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে, এমন নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে, আশে পাশেই আছে এমন হাজারো উদাহরণ। ম্যাটারনিটি লিভ শেষে কাজে ফিরতে নিজেকে আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন। সব সিচুয়েশনেই পজিটিভ থাকুন। অনেক অনেক শুভ কামনা নতুন মায়েদের জন্য। ভালো থাকবেন।
ছবি- সাটারস্টক