আজকের এই লেখাটি কোন একাডেমিক জার্নাল থেকে নয় বরং পুলিশ অফিসার হিসেবে আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা এবং সেইসাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য কেইস থেকে পাওয়া ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে লেখা। ব্যস্ত পাঠক যদি একজন মানুষের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন, এ লেখাটি এড়িয়ে যেতে পারেন। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি আপনার সম্পর্কের ১) নিপীড়ণ চিহ্নিত করতে পেরেছেন এবং ২) মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এই সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সবচাইতে বড় যে বাধাটি আসে তা হচ্ছে “সমাজ”। এই সমাজের ভয়ে কী পারিবারিক নিপীড়ন সহ্য করেই যাবেন?
ধৃষ্টতামূলক শোনাতে পারে তবুও সোজাসাপ্টা ভাষায় বলি – বাংলাদেশের সমাজের আমি খুব বড় একটা ভক্ত নই। সমাজ জিনিসটাকে আমার নিপীড়িতের উপর যাবতীয় অন্যায় জায়েজ করার একটা হাতিয়ার বলে মনে হয়। আসুন, দেখি সমাজ বলতে আমরা কি বুঝিঃ
১) বাবা মা
বাংলাদেশের অধিকাংশ বাবা-মা সন্তানের নিপীড়িত হবার খবর জানলেও “সমাজের” ভয়ে “মানিয়ে” নিতে বলেন। মেয়ে-জামাই গায়ে হাত তোলে? “মানিয়ে নে, মা।” কথায় কথায় মেয়েকে অপমান করে? “শ্বশুরবাড়িতে এরকম হয়ই, মা”।
স্বামী লম্পট হোক, ড্রাগী হোক, নির্যাতনকারী হোক, বদমায়েশ হোক – ওই একই ডায়ালগ- “মানিয়ে নে, মা”
সবচাইতে দুঃখজনক যে ব্যাপারটি আমার কাছে আশ্চর্য লাগে তা হচ্ছে, যে বাবা মা প্রাণে ধরে সন্তানের গায়ে কোনদিন আঁচ লাগতে দেননি, সেই তাঁরাই “সমাজ” এর ভয়ে মেয়েকে বাধ্য করেন দিনের পর দিন অত্যাচার মেনে নিতে।
এই “সমাজ” হচ্ছে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, কর্মক্ষেত্রের কলিগ, সকাল বেলা হাঁটার সঙ্গী। বিয়ের অনুষ্ঠানে যেসব লোকের সাথে হয়ত দশ বছর পর দেখা হয়েছে এবং অনুষ্ঠানের পর আগামী দশ বছরেও দেখা হবার কোন সম্ভবনা নেই, সেইসব লোকদের নিয়ে গড়া “সমাজ” কি বলবে এই ভয়ে অবলীলায় নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে নরকবাসে বাধ্য করেন বাবা মা।
২) খালা ফুপু মামা মামী ইত্যাদি
উত্তরায় তুরাগ থানা থেকে সেক্টর চার – এ খালি পায়ে কাঁদতে কাঁদতে এক ভদ্রমহিলা এলেন আমার অফিসে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল ভদ্রঘরের মেয়ে, কিন্তু এতদূর খালি পায়ে কাঁদতে কাঁদতে পুলিশের কাছে আসতে দেখে বিস্তারিত শুনতে চাইলাম। এই ভদ্রমহিলাকে সকাল বিকাল তার স্বামী শারীরিক নির্যাতন করেন যৌতুকের জন্য, আজকে তাঁর একমাত্র সন্তানকে আটকে রেখে ঘর থেকে এক বস্ত্রে এই সন্ধ্যেবেলা বের করে দিয়েছেন স্বামীদেবতাটি।
মেয়েটির বাবা নেই, সৎ বাবার সাথে মা ক্যানাডা থাকেন। মায়ের স্বামী ভদ্রলোকটি অসম্ভব হৃদয়বান- তিনি বলেছিলেন, “মা রে , তোকে জন্ম দেইনি মানে এই না যে তোর ভরণপোষণ করব না। তুই তোর মেয়েকে নিয়ে কানাডা চলে আয়”
মেয়ের মা-ও একই কথা বললেন। আমিও বললাম, যে স্বামী একবার আপনার গায়ে হাত তুলেছে সে মরে গেলেও শোধরাবে না।আপনি দ্রুত ডিভোর্স দিন, প্রয়োজনে তার নামে মামলা করুন – তারপর কানাডাতে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করুন।
দুদিন পরে শুনি মেয়ের খালা, চাচী আর ফুপুর দল “সংসার” না ভাঙার কথা বলে মেয়েটিকে স্বামীর ঘরে ফেরত পাঠিয়েছে।
ফলাফল জানাই ছিল, ঠিক এক মাসের মাথায় সেই আগের মতই নির্যাতন নিপীড়ণ শুরু। ততদিনে আমি বদলী হয়ে গিয়েছি অন্য জায়গায়। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যতদূর জানি, নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। এই মামা-চাচা-ফুপুর দল কিন্তু তখন কেউ এই মেয়েটাকে আশ্রয় দিতে রাজী হয়নি!
৩) বন্ধু বান্ধবী বান্ধবীর স্বামী
ইংল্যান্ডের একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে অদিতি। ভালবেসে বিয়ে করেছিল অর্জুনকে, কিন্তু বিয়ের পরেই ভালবাসার মানুষটি পালটে গেল, দেখাতে লাগল তার কদর্য রূপ। প্রচন্ড রকমের কন্ট্রোলিং, পান থেকে চুন খসতে দুর্ব্যবহার, মায়ের অসুখের সময়েও দেখা করতে না দেওয়া, বন্ধুবান্ধবের কাছে তাকে পাগল হিসেবে আখ্যা দেওয়া এটাকে ইংরেজিতে গ্যাসলাইটিং বলে যা এক ধরণের নিপীড়ণ), তার পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারকে খাটো করা, যৌন নির্যাতন – এমন কিছু নেই যা সে করতো না। যেহেতু ভালবেসে সবার অমতে বিয়ে করেছে, অদিতি কাউকে বলতেও পারতনা।
একটা পর্যায়ে অতিষ্ট হয়ে শক্ত সিদ্ধান্ত নিল অদিতি, বেঁচে থাকতে এই বদমায়েশের সাথে সংসার করবে না ও- দেশে বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে।
এই নিপীড়কেরা প্রচন্ড চালাক হয়, বাইরের দুনিয়ার কাছে এরা এত ভালো আচরণ করে যে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এই মানুষটাই চার দেয়ালের ভেতরে তিলে তিলে নির্যাতন করে অসহায় স্ত্রীকে।
অর্জুন যখন দেখতে পেল আসলেই অদিতি চলে যাচ্ছে, তখন সে কমন ফ্রেন্ড এবং তাদের স্পাউসদের মাধ্যমে হাত করতে চাইল অদিতিকে। অদিতির সবচাইতে কাছের বান্ধবীরা ডায়রেক্ট পল্টি খেল, বুঝতে চাইলোনা ওর কষ্টটা। এক বান্ধবীর স্বামী আবার একটু নেতাগোছের – সে আবার এল মিটমাট করিয়ে দিতে, যেন মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেই এতদিনের নিপীড়ণ মুছে যাবে। নোংরা কৌশল হিসেবে অদিতিকেই দোষ দিতে থাকল এরকম বলে, “হ্যা, ফেসবুকে তোমার ছবিতে অন্য ছেলে লাইক দিলে স্বামী তো রাগ করবেই!”
আরেক বান্ধবীর স্বামী আবার এক কাঠি সরেস, অদিতির দুঃসময়ে বাজিয়ে দেখতে চাইল “চান্স পে ডান্স” করা যায় কিনা। কথায় কথায় খালি বলত, “ইশ, তোমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেকদিন “কিছু” হয়নি- অসুবিধা হলে আমাকে জানিও, “হেল্প” করব।
রাগে-ঘৃণায় অদিতির ইচ্ছে করত বদমায়েশটার অণ্ডকোষ বরাবর কষে দুটো লাথি বসাতে যাতে ইহজীবনে বাবা হতে না পারে।
৪) বাকি পুরুষ মানুষ
সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড, সুযোগ পেলে পহেলা বৈশাখে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া বাঙালি পুরুষদের বোঝাতে একটা প্রবাদই যথেষ্ট – “পুরুষ মানুষ কখনো কারও খালু হয় না”
আমি বলছি না সমাজে উদার, চরিত্রবান, পিতৃ বা ভাতৃস্থানীয় পুরুষ মানুষ নেই। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ প্রশ্নাতীতভাবে আস্থার প্রমাণ রাখছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে বিশ্বাস করা আর সাপের গর্তে পা রাখা একই ধরণের নির্বুদ্ধিতা। জানি, বহু সুশীল নারী এবং পুরুষ এ কথাটি বলার জন্যে “আপনার ঘরে কি বাপ ভাই নাই” বলে শিং বাগিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসবেন।
ভাইয়া এবং আপুরা, এই অধম যা দেখেছে আপনারা তা দেখেন নি। ঠিক এ লেখাটি যখন লিখছি, সুদূর জাপানে বসে বাংলাদেশে পিতা কর্তৃক আপন কন্যা সন্তান ধর্ষণের কতজন ভিকটিমের সাথে আমার সরাসরি কথা হচ্ছে – সেটা বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন না।
রঙিন যে চশমা লাগানো অবস্থায় পৃথিবীটা আপনারা দেখেন, ওটা খুলে এদিক ওদিক তাকালে বুঝতে পারবেন- উই লিভ ইন আ ব্লাডি জাঙ্গল।
৫) শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয়
এনাদের কথা আর বললাম না, বুঝে নিন। আপনার নামে এমন ভয়াবহ সব গুজব ছড়াবে যে বমি করে দেবেন। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন!
করনীয়ঃ
বুঝতেই পারছেন, একলা চলার সিদ্ধান্ত যখন নেবেন – উপরের সবার সাথে লড়তে হবে আপনার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা হয়, অন্ততঃ বাবা-মা একটা পর্যায়ে গিয়ে সন্তানের কষ্ট বোঝেন এবং তাকে সহায়তা করেন। কারও সহায়তা যাতে প্রয়োজন না হয় সেজন্যে নিজেকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে হবে – এটা হচ্ছে প্রথম এবং প্রধান কথা। যদি নয়া হয়ে থাকেন, আজ থেকে শুরু করুন – ইটস নেভার লেট টু স্টার্ট। মনে রাখবেন, আপনি যখন ঘরের ভেতরে স্বামী নামক পশুটার দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছিলেন, সমাজ তো সমাজ আপন মা-ও কিন্তু পাশে ছিল না ওই মুহুর্তে।
সমাজ আপনার ইলেকট্রিক বিল দেবে না, আপনার ভাত খাওয়ার পয়সাও দেবে না, সুযোগ পেলেই আপনাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে, আপনার অসহায়ত্বের সুযোগ নেবে।
এই সমাজের ভয়ে নিপীড়ন না সয়ে সমাজের মুখোমুখি হতে হলে কি করতে হবে তা অষ্টাদশ শতাব্দীর জাপানী বিপ্লবী কবি তামাহোমা-সান এর ভাষায় শুনুনঃ
“সমাজ বাঁধন পরিয়ে পায়ে, গলায় দিয়ে ফাঁস
খাচ্ছে তোকে চেটেপুটে, লুটছে বারো মাস
আর না করে কান্নাকাটি
হাতে তুলে যুদ্ধলাঠি
শিশ্ন ছিঁড়ে নে রে নারী, ফ্যাল রে এবার লাশ!”
চলবে…
ছবিঃ সংগৃহীত – Shutterstock