নিশ্চয়ই আপনারা একমত হবেন যে, ধীরে ধীরে দেশে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ! কোনো দাওয়াতে গিয়ে গামলা ভর্তি করে তেল চপচপে খাবার সাবাড় করে বড়াই করা, এমন কি চায়ে ৩-৪ চামচ চিনি খাওয়ার মতো কাজগুলো মানুষ এখন অনেকটাই এড়িয়ে চলছেন, তাই না? আর এক্সারসাইজ , যা কিনা আগে ছিলো শুধুই উচ্চশ্রেণীর মানুষের ‘শখ’, এখন যুগের প্রয়োজনে সবাই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটিকে শখ বা টাইম পাসের তালিকা থেকে সরিয়ে এনে নিজের ডেইলি রুটিনে ফিট করার চেষ্টা করছেন। মানুষের মেন্টালিটির চেঞ্জের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে এক ধরনের হেলথ ফুডের বাজার। যারা অনেক চেষ্টা করেও অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার ব্যাড হ্যাবিট ছাড়তে পাড়ছেন না, এসব হেলথ ফুডের চক্করে তারাই পড়ছেন। আজকের ফিচারে জানাবো স্বাস্থ্যকর খাবার ভেবে যে অস্বাস্থ্যকর খাবার আমরা প্রতিনিয়ত খেয়ে চলেছি তা সম্পর্কে বিস্তারিত।
সুস্থ থাকতে এড়িয়ে চলুন এই ৪টি অস্বাস্থ্যকর খাবার
ফুড হ্যাবিট একদিনে কখনোই পরিবর্তন করা যায় না। কেউ তো আর একদিনে চিনি খাওয়া বাদ দিতে পারে না অথবা সাদা ভাত ছেড়ে দিতে পারে না!! মাঝখানে নির্দিষ্ট ট্রানজিশন পিরিয়ড তো সবার দরকার হয়!
কিন্তু আসল সমস্যা কোথায় জানেন? আমরা অনেক আনহেলদি খাবারকেও হেলদি বলে মনে করে সেগুলো খেয়ে হেলথের বারোটা বাজিয়ে ফেলি। চিনি খাওয়া ছাড়বেন, কিন্তু মিষ্টি খেতে ভালো লাগে। তাহলে ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ডায়েট কোক বা সুগার সাবস্টিটিউট। পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে স্বাস্থ্যকর খাবার নামক কিছু প্রোডাক্টের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের হেলথের সর্বনাশ করছেন অনেকেই। তাহলে চলুন স্বাস্থ্যকর ট্যাগ লাগানো কিছু অস্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
(১) সুগার ফ্রি ফুড বা সুগার সাবস্টিটিউট
চিনির অল্টারনেটিভ হিসেবে এটাই সবচেয়ে প্রচলিত। সবাই জানে চিনি খাওয়া স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের জন্য কতটা খারাপ। তাই যারা ওজন কমানোর প্রসেসের মধ্যে আছেন তাদের তো সবার আগে রেগুলার ডায়েট থেকে চিনিটাই বাদ দিতে হবে। কিন্তু কিছু সুগার সাবস্টিটিউটের অ্যাড দেখে সবাই ভাবেন, “এখন থেকে চিনির বদলে এটাই খাবো। মিষ্টিটা তো খেতে পারবো অ্যাটলিস্ট!”
আমাদের দেশে যেসব সুগার সাবস্টিটিউট ইউজ করা হয়, তার মধ্যে কয়েকটি হলো স্যাকারিন, আস্পারটেম, সুক্রালজ ইত্ত্যাদি। বিভিন্ন দোকানের সুগার ফ্রি মিষ্টিগুলোতেও এগুলোই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সারাজীবন চিনির বদলে এগুলো খাওয়া যাবে কি না জানেন? আসলে এই কেমিক্যালগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে মাথা ব্যথা, পেটে সমস্যা, কিডনি ফেইলিওর, ব্রেইন টিউমার পর্যন্ত হতে পারে। তাহলে চিন্তা করুন, অস্বাস্থ্যকর চিনির বদলে নিজের জন্য অথবা নিজের প্রিয়জনের জন্য চিনির চাইতেও ভয়াবহ কিছু বেছে নিচ্ছেন নাতো??
(২) ডায়েট কোল্ড ড্রিংকস
কমবয়সী স্বাস্থ্য সচেতন ছেলেমেয়েদের মধ্যে ডায়েট কোল্ড ড্রিংক খুবই পপুলার। তারা মনে করে রেগুলার কোল্ড ড্রিংকের এত এত ক্যালরিকে একটা ডায়েট ড্রিংক দিয়েই তো কাটিয়ে দেওয়া যায়। এটা আসলে ফলস মেন্টাল স্যাটিসফ্যাকশন ছাড়া আর কিছুই না।
কেন জানেন? ডায়েট ড্রিংকে সবসময়ই আর্টিফিশিয়াল সুইটেনার ইউজ করা হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করলে, নরমাল ড্রিংকের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে ডায়েট কোল্ড ড্রিংক কিনে হেলথ রিস্কে পড়ার চাইতে আমি ব্যক্তিগতভাবে নরমাল চিনিযুক্ত অস্বাস্থ্যকর কোল্ড ড্রিংকই পরিমিত হারে পান করাকে ভালো আইডিয়া বলে মনে করবো।
(৩) ফ্যাট ফ্রি খাবার
কোনো ডায়েট চার্ট শেয়ার করা হলে অনেকেই দেখি বলেন, “কোনো কাজ হয় না, আমি এর চেয়ে অনেক কম খাই, ওজন কমে না!” কিন্তু আমি যদি বলি, কম খাওয়ার জন্যই আপনার ওজন কমছে না? অনেকেই আছেন বেশি স্বাস্থ্যসচেতনতা ও কম জ্ঞানের কারণে খাবারের লিস্ট ছোট করতে করতে শরীরের বেসিক দরকারি পুষ্টিটুকু পর্যন্ত বাদ দিয়ে দেন। এমনি একটি উপাদান হলো ফ্যাট।
“চর্বি খেলে মোটা হয়”- এই কনসেপ্ট থেকে খাবারের তালিকা থেকে পুরোপুরি ফ্যাট বাদ দেওয়ার ফলে কী কী সমস্যা হয়?
১) স্কিন রাফ হয়ে যায়। আমাদের স্কিন ভালো রাখার জন্য ফ্যাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল করেছেন কেউ হঠাৎ ক্র্যাশ ডায়েট করলে তার ত্বকের অবস্থা কত খারাপ হয়ে যায়? অথচ সে কিন্তু ডায়েটে তথাকথিত হেলদি ফুডের কোনো কমতি রাখে না। কিন্তু ডায়েট থেকে ফ্যাট বাদ দিয়ে দেওয়ার কারণে স্কিনের সেই গ্লো ই হারিয়ে যায়।
২) শরীরের মেটাবলিজম কমে যায়, মানে শরীর তখন দরকারি ফ্যাটের অভাবে সব খাবারই না পুড়িয়ে ফ্যাটে বদলে ফেলে দরকারি পুষ্টি সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। ফলাফল? আপনি খাওয়া কমাতে কমাতে প্রায় ছেড়ে দিলেও আপনার ওজন কমে না!!
৩) বিভিন্ন খাবার হজম হওয়ার জন্য দরকার নুন্যতম ফ্যাট। এ কারণে স্কিমড মিল্ক বা ননি বিহীন দুধ খুবই খারাপ খাবার। কারণ এতে দুধ হজম হবার মতো দরকারি ফ্যাট না থাকায় অনেকেই হজমের সমস্যায় ভোগেন।
৪) ফ্যাট থেকে আমরা পাই প্রচুর দরকারি ভিটামিন ও খনিজ, যেগুলোর অভাবে দেহ ধীরে ধীরে তার কর্মক্ষমতা হারায়।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফ্যাট ফ্রি খাবারগুলো হয় বিস্বাদ, সুতরাং খাবারের স্বাদ ও বিক্রি দুটোই বাড়াতে বিক্রেতারা এতে অ্যাড করেন অতিরিক্ত লবণ ও আর্টিফিশিয়াল স্বাদবর্ধক, যা আমাদের দেহে ওয়াটার রিটেনশন, হার্টের প্রবলেম, কিডনি সমস্যা বা অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড প্রেশার হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং, পরিমিত খাওয়ার হ্যাবিট গড়ে না তুলে দরকারি পুষ্টি বাদ দেওয়ায় অথবা ফ্যাট ফ্রি শর্টকাট নেয়ার মতলবটা কিন্তু খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় বুঝতেই পারছেন!
(৪) ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল
আপনি কি মনে করেন কোনো ডায়েট বা এক্সারসাইজ ছাড়া নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের একটি সিরিয়াল খেয়ে আপনার ওজন কমিয়ে আপনি পুরোপুরি ফিট ও হেলদি হয়ে যাবেন? ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল খাওয়া খারাপ কিছু না। তবে নরমাল ময়দার রুটির বদলে সিরিয়ালকে স্বাস্থ্যকর ভাবাটা হচ্ছে খারাপ। কারণ সত্যি এতে এমন কিছুই নেই যা ময়দার রুটিতে নেই। কিন্তু এটাকে টেস্টি বানানোর জন্য এতে নানা কেমিক্যাল অ্যাড করা হতে পারে, সাথে থাকতে পারে আর্টিফিশিয়াল ফ্লেভার এজেন্ট। অনেকে আবার অল্প খেয়ে ক্ষুধা মেটাতে না পেরে পরিমাণে এত বেশি খান, যে ৪-৫টা রুটির সমান ক্যালরির সিরিয়াল খেয়ে নেন। তাহলে এই হেলদি ফুড খেয়ে আপনার কী উপকার হলো?এর চাইতে বরং সাদা ময়দা অথবা আটার রুটির বদলে পরিমিত পরিমাণে লাল আটার রুটি খান। একই সাথে পুষ্টি ও ভালো স্বাস্থ্য দু’টোই পাবেন।
পরিশেষে বলতে চাই, অতিরিক্ত ওজন কমানো যদি শুধু একটা নির্দিষ্ট খাবার খেয়েই সম্ভব হতো, তবে সারা দুনিয়ার মানুষ এক্সারসাইজ করাই ছেড়ে দিতো, তাই না? এতটুকু চিন্তা করলেই অনেক বড় বড় হেলথ রিস্ক থেকে আপনারা বেঁচে যেতে পারবেন কিন্তু। আশা করি ভবিষ্যতে ডায়েট আর হেলথের চিন্তায় এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার আগে দুইবার চিন্তা করবেন। মনে রাখবেন, হেলদি থাকতে চাইলে প্রোপার ডায়েট আর এক্সারসাইজের কোনো বিকল্প নেই।
লিখেছেন – তাবাসসুম মুস্তারি মীম
ছবিঃ সাটারস্টক