পানচিনি, মেহেদি, গায়ে হলুদ, ব্রাইডাল শাওয়ার, বিয়ে, বৌভাত – একটি বিয়েতে কত আনুষ্ঠানিকতাই না মানুষ পালন করে। সবটা মিলেই বিয়ে যেন ঠিক একটি উৎসব। আর আকাশ সংস্কৃতির ছোঁয়ায় দিনকে দিন সে উৎসবের পরিধি শুধু বাড়ছেই! আজকাল নিজেরা নিজেরা বিয়ের অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি সবকিছু নিয়ে মাথা ব্যথাটা আর কেউ সহজে নিতে চান না। ওয়েডিং প্ল্যানিং-এর এই মাথা ব্যথাটা যেঁচে নিজের ঘাড়ে নেয়ার জন্য নানান ধরনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছরে বেশ গুছিয়ে উঠেছে। বিয়ের আয়োজনকে একদম পরিপাটি রূপকথায় পরিণত করে তুলতে যেন তারা সদা প্রস্তুত। তেমনই একজন হলেন নুসরাত নওরিন । ‘ওয়েডিং ডেকোর বাই নুসরাত’ নামে তার প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যেই বেশ নজর কেড়েছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে। সাজগোজের আজকের আড্ডায় তাই নুসরাত এসেছেন ওয়েডিং প্ল্যানিং ক্যারিয়ারের খুঁটিনাটি জানাতে।
শুভেচ্ছা নওরীন আপনাকে। নিজের সম্পর্কে সাজগোজের পাঠকদেরকে সংক্ষেপে একটু বলুন।
ধন্যবাদ সাজগোজকে। আমরা ৩ টি বোন, তার মধ্যে আমি সবার চেয়ে ছোট। আমি ছোটবেলা থেকেই শিল্পের প্রতি খুব আসক্ত ছিলাম। কাগজ, কাঁচি এসব আমার সাথেই থাকত সবসময়। এটা-সেটা কেটেকুটে বানাতে আমার খুবই ভালো লাগত। ধীরে ধীরে এই আসক্তি কেবল বেড়েছেই, কমেনি একটুও।
যদিও আমি পড়াশোনা করেছি অ্যাকাউন্টিঙে, কিন্তু সৃজনশীল কাজে প্যাশন থাকায় ক্যারিয়ারও শুরু করেছি সেভাবেই। টুকটাক গায়ে হলুদের গহনা বানাতে বানাতেই হঠাৎ ওয়েডিং প্ল্যানিং নিয়ে সিরিয়াস হলাম। আমার কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ড আর সৃজনীশক্তিই আমার ক্যারিয়ারের মূলধন ছিল। সেই থেকে ‘ওয়েডিং ডেকোর বাই নুসরাত’ নিয়েই আছি! এই টিমটি নিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি কাজ করেছি। ‘বিয়ে’-কে ফোকাস করেই আমরা এগোচ্ছি।
ওয়েডিং প্ল্যানিঙের শুরু কীভাবে? উৎসাহ কোথা থেকে এসেছিল?
বিয়ে ব্যাপারটি সবসময়ই একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বিশেষ, জাকজমকপূর্ণ ও আনন্দঘন মুহূর্ত। আমি যখনই আমার নিজ পরিবারের কারও বিয়ের প্রোগ্রাম সাজাতাম, আমি ভাবতাম কী করে আরও এক্সক্লুসিভ করা যায়। স্বজনদের বিয়ের প্রোগ্রামের ডেকোরেশানে প্রচুর প্রশংসাও কুড়িয়েছি আমি। এরপর আমি ভেবে দেখলাম তাহলে আমি শুধু নিজের গন্ডিতে কেন আটকে আছি? এই গন্ডিটাকে আরেকটু বড় করে আমিওতো পারি ওয়েডিং প্ল্যানিংকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে! এসমস্ত চিন্তা থেকেই ২০১০ সাল থেকে প্রফেশনালি আমার ‘ওয়েডিং ডেকোর বাই নুসরাত’ এর পথচলা শুরু। প্রথম দিকে টুকিটাকি হলুদের গহনা বানাতাম। আর এখন প্রায় ৭৫ জনের একটি টিম নিয়ে হলুদের গহনা থেকে শুরু করে ডালা ডেকোর, মেহেদি, হ্যান্ডমেইড কার্ড, গিফট বক্স, রাখি তৈরি, ফুড ডেকোর, স্টেজ ডেকোরেশান, পালকি, ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি, ডিজে, সাউন্ড, লাইটিং, গাড়ি ও বাসর সজ্জা মেকওভারসহ আরও অনেককিছু প্রতিনিয়ত সেবা দিয়ে যাচ্ছে ‘ওয়েডিং ডেকোর বাই নুসরাত’। এখন পর্যন্ত আমরা প্রায় ৩ শতাধিক বিয়ের কাজ করেছি। আমরা এখনও পর্যন্ত অনলাইনেই সেবা দিয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ, অনলাইনে ডিজাইন দেখে আগ্রহীরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন, এরপর মিটিং হয় বেশ কয়েকবার। আমাদের ফ্যান পেইজের ঠিকানাঃ www.facebook.com/weddingdecorbynushrat
আপনাদের কাজের ধরন সম্পর্কে একটু ধারণা দিন।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কাজে সাধারণত চাপ থাকে প্রচুর। আমরা আমাদের ক্লায়েন্টদেরকে ক্লায়েন্ট বলি না কখনও। তাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তাদের পরিবারের একরকম সদস্যের মতই হয়ে যাই, খুব বন্ধুত্বপূর্ণ একটি পরিবেশ বজায় রাখি সবসময়। শুরুতে আমরা মনোযোগ ও অনেক সময় দিয়ে তাদের চাওয়াটা কেমন সেটা শুনে নিই। এরপর কিছু কাজের স্যাম্পল দেখাই। অনেক সময় নিজের সাজেশানও দিই। তারপর খানিক হোক ওয়ার্ক করে নিই প্ল্যান তৈরির আগে। এরপর ২য় মিটিঙে আমরা পুরো প্রোগ্রামের প্ল্যানটির একটি প্রেজেন্টেশান দিই। ৩য় মিটিঙে সবকিছু ফাইনাল হয়। অনবরত একটা যোগাযোগতো থাকেই। এরপর আমরা নীল নকশাটাকে অনুষ্ঠানের দিন কিংবা আগের দিন মন-প্রাণ দিয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। সাধারণত পুরো ডিজাইন আর প্ল্যান আমিই করি, তবে কাজগুলো টিমের সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে দিই। হলুদের গহনাটা আমি নিজেই বানাই সবসময়। কাঁচামালের তালিকা তৈরি করা, কর্মী নিয়োগ, সময় ব্যবস্থাপনা এসবও আমাকে মাথায় রাখতে হয়। দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিটি কাজের নির্দেশনা দিই, এক্সট্রা ভ্যালু যোগ করার চেষ্টা করি, ফুলের সেটিংটা দেখি, কাজের শেষে কিছু সংশোধন বাকি থাকলে সেটিও দেখে দিই। এছাড়া আমাদের একটি ইউনিক বৈশিষ্ট্য হল আমরা ক্লায়েন্টের বাজেট বুঝে কাজ করি, আমাদের ডিজাইনে প্রচুর কাস্টমাইজেশান থাকে ক্লায়েন্টের চাহিদানুযায়ী। আর আমাদের কাজে বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রাধান্যটাই সবসময়ে দেয়ার চেষ্টা করি। আর আমাদের ডিজাইনে ফুলের ব্যবহার থাকে চোখে পড়ার মত। আমাদের কাজের মূল শক্তিই হল ক্লায়েন্টদের আবেগ। একটি কাজ শেষ করার পর তাদের প্রতিক্রিয়া দেখেই মন আনন্দে ভরে যায় আমাদের।
আমরা একদিনে প্রায় ৫ টি বিয়ের অনুষ্ঠান নামিয়ে ফেলতে পারি। ভালোবাসা আর প্রচুর ডেডিকেশান নিয়ে কাজ করি বলেই সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে।
২০১২ সালে ‘ওয়েডিং ডেকোর বাই নুসরাত’ ধানমণ্ডির দৃক গ্যালারিতে সর্বপ্রথম আয়োজন করে “ওয়েডিং ফেয়ার -২০১২” শিরোনামে একক একটি প্রদর্শনী। বাংলাদেশে বিয়ের ডেকোরেশন নিয়ে এটিই ছিল সর্বপ্রথম একক প্রদর্শনী।
কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কি?
ভবিষ্যতে আরও গুছিয়ে কাজ করতে চাই। আপাতত মিরপুরে আমাদের একটি অস্থায়ী অফিস আছে, তবে সামনে একটি নিজস্ব স্টুডিও করার ইচ্ছে আছে। আর কোন নতুন কোন উইংস খোলার আপাতত ইচ্ছে নেই, বিয়ের অনুষ্ঠানই মূল ফোকাস।
কোন বাধা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন কখনও এই কাজে? সেগুলো মোকাবিলা করলেন কীভাবে?
আমি আসলে সব ধরনের অভিজ্ঞতাই খুব উপভোগ করি, সে ভালো হোক কিংবা খারাপ। ভবিষ্যতের শিক্ষা হিসেবেই নেই সেগুলোকে। সে হিসেবে তেমন কোন বাধার সম্মুখীন এখনও পর্যন্ত হইনি। তবে সময় ব্যবস্থাপনা, টিম ব্যবস্থাপনা, নেটওয়ার্কিং, ডিজাইনে হঠাৎ বদল এসব হল এই পেশার চ্যালেঞ্জ। সেটিকে হাসিমুখে হ্যান্ডেল করা গেলে অভিজ্ঞতাটা খুব একটা মন্দ নয়।
বাংলাদেশে এই ধরনের সৃজনশীল কাজের ভবিষ্যৎ কী রকম বলে আপনার মনে হয়?
ওয়েডিং প্ল্যানিং খুবই ক্রিয়েটিভ একটি সেক্টর এখানকার তরুণদের জন্য। অনেক বেশি প্রতিযোগিতা থাকলেও এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে, এবং সুযোগও রয়েছে সেই সাথে। তাছাড়া মেয়েদের জন্য ওয়েডিং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি জায়গা।
কী ধরনের গুণ বা প্লাস পয়েন্ট থাকা জরুরি এ ধরণের কাজে? কীভাবে প্রস্তুত করতে হবে নিজেকে?
আসলে ওয়েডিং প্ল্যানিং পেশায় ইতিমধ্যে প্রচুর প্রতিযোগিতা তৈরি হয়ে গেছে। এত এত প্রতিযোগীর ভিড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে এমন কিছু একটা ইউনিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, যেটা দিয়ে খুব সহজেই নিজেকে সবার থেকে আলাদা করা যাবে এবং খুব সহজে কেউ তা নকলও করতে পারবে না।
এছাড়া কাজের প্রতি প্রচুর প্যাশন থাকতে হবে। কমন সেন্স ও অভিজ্ঞতাতো প্লাস পয়েন্ট। তাড়াহুড়ো করা যাবে না, প্রজেক্ট ধরে ধরে একটু একটু করে এগোতে হবে। আইডিয়া, দক্ষতা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, মার্কেট, চাহিদা ও প্রতিযোগী সম্পর্কে ধারণা, দূরদর্শিতা, সর্বোপরি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে অনেক বেশি পরিমাণে। আর অনেক অনেক স্টাডি করতে হবে সেক্টরটাকে। আমি সবসময়ই একটা জিনিস মেনে চলি, সেটি হল “প্রফিট নয়, পার্ফরম করো”। হ্যাঁ, আপনাকে প্রচুর পার্ফরম্যান্স দেখাতে হবে এই সেক্টরে উজ্জ্বল হতে চাইলে। পরিশ্রম করতে থাকুন, সাফল্য আসবেই।
অনেক ধন্যবাদ নুসরাত আপনাকে। শুভ কামনা রইল ‘ওয়েডিং ডেকোর বাই নুসরাত’ এর জন্য।
সাজগোজকেও ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা।
সাক্ষাৎকার গ্রহণঃ নুজহাত ফারহানা