পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন। ছোট্ট নতুন অতিথিকে নিয়ে সবাই বেশ আনন্দিত। হঠাৎ দেখা গেলো শিশুটির পায়ের নিচে বেশ বড় কালো একটি দাগ। সহজ ভাষায় বললে জন্মদাগ। কেউ এটি দেখে স্বাভাবিকই ভাবলেন, কেউ একটু চিন্তিত হলেন। জন্মদাগ নিয়ে শিশুর জন্মানো ছাড়াও বয়স বাড়ার সাথে সাথে নতুন করে তিল হতে পারে। যেগুলো এক সময় বড় হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জন্মদাগ ও তিল কি জটিল কোনো বিষয়? এর কারণে ভবিষ্যতে কি শিশুর বা প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হবে? আজকের আর্টিকেলে আমরা এ বিষয়েই বিস্তারিত জানবো।
জন্মদাগ ও তিল কি জটিল কোনো বিষয়?
মেলানোসাইটিক নেভাস
জন্মদাগকে চিকিৎসার ভাষায় মেলানোসাইটিক নেভাস বলা হয়। মেলানোসাইটিক নেভাস বা মোল হলো ত্বকের মেলানোসাইটের (রঙ্গক কোষ) একটি সাধারণ ক্ষত। একটি বাদামী বা কালো মেলানোসাইটিক নেভাসে পিগমেন্ট মেলানিন থাকে, তাই একে পিগমেন্টেড নেভাসও বলা যেতে পারে। এটি জন্মের সময় থেকেই বা জন্মের পর যে কোনো সময় হতে পারে।
কাদের হয়?
১) প্রায় প্রত্যেকেরই অন্তত একটি করে মেলানোসাইটিক নেভাস থাকে।
২) প্রায় ১% ব্যক্তি এক বা একাধিক জন্মগত মেলানোসাইটিক নেভাস নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং এটি সাধারণত বিক্ষিপ্তভাবে শরীরে ছড়ানো থাকে।
৩) কালো চামড়ার লোকদের তুলনায় ফর্সা চামড়ার লোকদের মেলানোসাইটিক নেভাস বেশি থাকে।
৪) শৈশব বা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে যে কোনো সময় দেখা দেয়। এরা সূর্যের সংস্পর্শে আসার কারণে বিবর্ণ হতে পারে কিংবা একেবারে মিলিয়েও যেতে পারে।
কারণ
১) যদিও নেভাস কোষগুলোর বিস্তারের সঠিক কারণ জানা নেই। তবে এটি স্পষ্ট যে, একজন ব্যক্তির মেলানোসাইটিক নেভির সংখ্যা জেনেটিক কারণ, সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসার প্রবণতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।
২) মেলানোসাইটিক নেভিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও এমন নেভি থাকতে পারে।
৩) নতুন মেলানোসাইটিক নেভি তৈরি হওয়ার পর কিছু ঔষধের সাহায্যে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যায়। এদেরকে BRAF Inhibitor Drug বলে।
৪) অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে বসবাসকারী মানুষদের তুলনায় উত্তর ইউরোপে বসবাসকারী মানুষদের কম নেভাস আছে।
৫) ইমিউনোসাপ্রেসিভ চিকিৎসায় নেভির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
বৈশিষ্ট্য
- মেলানোসাইটিক নেভি ক্লিনিকাল, ডার্মাটোস্কোপিক এবং হিস্টোলজিক্যালি তিনটি আলাদাভাবে দেখতে গেলে ব্যাপক পার্থক্য চোখে পড়ে
- শরীরের যে কোনো অংশে এগুলো হতে পারে
- শরীরের বিভিন্ন অংশের অবস্থানের উপর নির্ভর করে তাদের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়
- এরা সমতল কিংবা অসমতল দু’রকমই হতে পারে
- এদের রঙ গোলাপী বা ত্বকের রঙের চেয়ে গাঢ় বাদামী, ইস্পাত নীল বা কালো হয়
- হালকা চামড়ার ব্যক্তিদের হালকা রঙের নেভি থাকে এবং গাঢ় চামড়ার ব্যক্তিদের গাঢ় বাদামী বা কালো নেভি থাকে
- বেশিরভাগ গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির হলেও কখনো কখনো মোলগুলো অস্বাভাবিক আকারেরও হতে পারে
- এগুলো আকারে কয়েক মিলিমিটার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার ব্যাস পর্যন্ত হয়ে থাকে
শ্রেণীবিভাগ
মেলানোসাইটিক সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হলোঃ
জন্মগত মেলানোসাইটিক নেভাস (congenial melanocytic nevus)
জন্মগত মেলানোসাইটিক নেভিকে তাদের আকার, আকৃতি এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অনুসারে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়।
ছোট আকৃতির নেভাস (small congenial nevus) : এদের আকার < ১.৫ সেন্টিমিটার হয়।
মাঝারি আকৃতির নেভাস( medium congenial nevus) : এদের আকার ১.৫ – ১৯.৯ সেন্টিমিটার হয়।
বড় আকৃতির নেভাস (giant nevus) : এরা সাধারণত > ২০ সেন্টিমিটার হয়।
হেয়ারি কনজেনিয়াল নেভাস (hairy congenial nevus) : এ ধরনের নেভাসে চুল থাকে। যা আমাদের স্বাভাবিক চুলের মতো নয়। এরা কিছুটা মোটা, শক্ত ও অসমান হয়।
অর্জিত মেলানোসাইটিক নেভাস (acquired melanocytic nevus)
অর্জিত মেলানোসাইটিক নেভাস সাধারণত জন্মের পর হয়। অনেকেই একে তিল (মোল) বলেন। অর্জিত মেলানোসাইটিক নেভিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার একটা অংশ নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। এর নাম সিগনেচার নেভি (signature nevi)।
সিগনেচার নেভি অনেকগুলো ছোট ছোট মোলের সমন্বয়ে একটা বড় মোল। এতে থাকা বিভিন্ন মোলগুলো হচ্ছেঃ
সলিড ব্রাউন নেভাস (Solid Brown nevus) : এদের রঙ পুরোটাই একই রকম বাদামী যার মধ্যে হালকা বা গাঢ় রঙের মিশেল নেই।
সলিড পিংক নেভাস (Solid pink nevus) : এই নেভাসটা সাধারণত সাদা চামড়ার মানুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এদের ত্বকে মেলানিন কম থাকায় এমনটি হয়।
একলিপ্স নেভাস (Eclipse nevus) : এ ধরনের নেভিসের মাঝের অংশ হালকা বাদামী এবং চারপাশে গাঢ় বাদামী অংশ দিয়ে ঘেরা। এদের বেশিরভাগ মাথার ত্বকে দেখতে পাওয়া যায়।
জটিলতা
১) বয়স বাড়ার সাথে সাথে মোল বা তিল হলে সেগুলো নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কারণ এই মোলগুলো থেকে ‘মেলানোমা’ নামে ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে।
২) প্রথমে এদেরকে নিরীহ মনে হলেও সময়ের সাথে সাথে কিছু কিছু নেভাস আরও ছড়িয়ে গিয়ে আকৃতিতে বড় হতে পারে।
৩) কম নেভি আছে এমন ব্যক্তিদের তুলনায় যাদের নেভির সংখ্যা বেশি (১০০ বা তার চেয়েও বেশি হলে), তাদের মেলানোমা হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
৪) মেলানোসাইটিক নেভি কখনো কখনো মেলানোমা ছাড়া অন্য কারণেও পরিবর্তিত হয়। যেমন- সূর্যের সংস্পর্শে আসার পরে বা গর্ভাবস্থায় এরা বড় হতে পারে, বাড়তে পারে কিংবা নিজে নিজেই নির্মূল হয়ে যেতে পারে।
সেলফ কেয়ার গাইড লাইন
মেলানোসাইটিক নেভাসের জন্য আলাদাভাবে কোনো অ্যাক্টিভিটি বা রেস্ট্রিকশন নেই। তবে সান প্রোটেকশন ক্লথ এবং ১ বছর বয়সের পর থেকে সানব্লক ব্যবহার করতে হবে। যারা মেকআপ করে বাইরে যাচ্ছেন, তারা অবশ্যই প্রোপার মেকআপ কভারেজ দিয়ে বের হবেন।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
জন্মদাগ নিয়ে কোনো শিশুর জন্ম হলে অন্তত একবার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসক নেভিসের আকৃতি, রঙ ও অবস্থান দেখে জানাবেন সেটি ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর কিনা। প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের যদি তিল অর্থাৎ মোলের আকৃতি নিয়ে কোনো কনফিউশন থাকে তখন চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন।
চিকিৎসা
বেশিরভাগ মেলানোসাইটিক নেভি ক্ষতিকর নয় এবং চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। কিন্তু নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে এদেরকে অপসারণ করা যেতে পারে।
১) ক্যান্সার ধারণা করা হলে তা ফেলে দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
২) যদি বিরক্তির কারণ হয়। যেমন- পোশাকে আটকে যাচ্ছে, কিংবা চুল আঁচড়ানোর সময় চিরুনির দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে অথবা ছেলেদের দাঁড়ি শেভ করার সময় ক্ষুর দ্বারা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে।
৩) তিল দেখতে যদি কুৎসিত মনে হয়।
অপসারণ পদ্ধতি
এক্সিশন বায়োপসি (Excision biopsy) : কোনো ক্যান্সার উপাদান আছে কিনা তা জানতে মোলের অংশটুক কেটে ল্যাবে পাঠানো হয়।
শেভ বায়োপসি (Shave biopsy) : এ পদ্ধতিতে উঁচু হয়ে থাকা তিলের অপসারণ করা হয়।
ইলেকট্রোসার্জিকাল ডিসট্রাকশন (Electrosurgical destruction) : এ পদ্ধতিতে সরাসরি ত্বক থেকে নেভি নির্মূল করা হয়।
লেজার (Laser) : মোল এর সংখ্যা কমানোর জন্য, রঙ হালকা করার জন্য এবং এর উপর থাকা চুল নির্মূল করার জন্য এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়।
মেলানোসাইটিক নেভাস নিয়ে দুশ্চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই। তবে যদি সন্দেহ হয়, অথবা এর কারণে কোনো সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। এতে মনের সন্দেহ দূর হবে। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক