এখনকার সময়ে ডায়াবেটিস খুব কমন একটি রোগ। আমাদের দেশে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কোনো বয়সের মানুষেরই এই রোগ হতে পারে। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যার কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ভয় না পেয়ে নিয়মিত ওজন নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত এক্সারসাইজ করা এই রোগীদের ভালো থাকতে সাহায্য করে। আজকের আর্টিকেলে শেয়ার করছি ডায়াবেটিস কী, কত ধরনের হতে পারে এবং এর চিকিৎসা।
ডায়াবেটিস কী?
এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যা আপনার দেহকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খেয়ে থাকি, আমাদের দেহ প্রথমে বেশিরভাগ খাবারকে চিনিতে (গ্লুকোজ) ভেঙ্গে ফেলে এবং তারপর রক্তপ্রবাহে ছেড়ে দেয়। যখন রক্তে শর্করা বেড়ে যায়, তখন এটি অগ্ন্যাশয়কে ইনসুলিন তৈরি করার জন্য সংকেত দেয়। ইনসুলিন আপনার শরীরের কোষে রক্তে গ্লুকোজকে এনার্জি হিসাবে ব্যবহারের জন্য একটি চাবিকাঠির মতো কাজ করে। ডায়াবেটিস রোগীর শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করে না বা প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করতে পারে না। যখন পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকে না বা কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতিক্রিয়া বন্ধ করে দেয়, তখন অত্যধিক গ্লুকোজ রক্তে থেকে যায়। সময়ের সাথে সাথে, এটি হৃদরোগ, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং কিডনি রোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ডায়াবেটিস কত ধরনের হয়?
ডায়াবেটিস টাইপ 1
টাইপ 1 ডায়াবেটিস একটি অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া দ্বারা সৃষ্ট বলে মনে করা হয় (শরীর ভুল করে নিজেকে আক্রমণ করে)। এই প্রতিক্রিয়ায় শরীর ইনসুলিন তৈরি করা বন্ধ করে দেয়। প্রায় ৫-১০% লোকের টাইপ 1 ডায়াবেটিস আছে। টাইপ 1 ডায়াবেটিস যে কোনো বয়সে হতে পারে এবং লক্ষণগুলো শরীরে খুব দ্রুত প্রকাশিত হয়। আপনার যদি এটি হয়ে থাকে, তবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হবে। বর্তমানে কেউ জানে না কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায়।
টাইপ 2 ডায়াবেটিস
এই ধরনের ডায়াবেটিসে শরীর ভালোভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না এবং রক্তে গ্লুকোজকে স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে পারে না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় ৯০-৯৫% মানুষের টাইপ 2 ডায়বেটিস আছে। এটি বহু বছর ধরে দেহে বিকাশ লাভ করে এবং সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নির্ণয় করা হয়। আপনি কোনো উপসর্গ লক্ষ্য নাও করতে পারেন, তাই ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রতিরোধ করা যেতে পারে বা সুস্থ জীবনধারা পরিবর্তনের সাথে বিলম্বিত হতে পারে।
গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে হয়ে থাকে, যাদের কখনো ডায়াবেটিস হয়নি। হবু মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যায় ঝুঁকি হতে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সাধারণত শিশুর জন্মের পরে চলে যায়। তবে, এটি পরবর্তী জীবনে টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও শিশু বা কিশোর বয়সে স্থূলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং পরবর্তী জীবনে এটি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
কী কারণে ডায়াবেটিস হয়?
ডায়াবেটিস হবার সঠিক কারণ এখনো অজানা। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় রক্ত প্রবাহে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। কারণ অগ্ন্যাশয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করে না। টাইপ 1 ও টাইপ 2 ডায়াবেটিস উভয়ই জিনগত বা পরিবেশগত কারণগুলোর সংমিশ্রণে হতে পারে।
ডায়াবেটিস হলে কী কী উপসর্গ থাকে?
- প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, রাতে এর প্রকোপ বাড়ে
- খুব তৃষ্ণার্ত থাকে
- চেষ্টা না করেই ওজন কমে যেতে পারে
- খুব ক্ষুধার্ত অনুভূত হয়
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে
- হাত বা পায়ে অসাড় বা ঝাঁঝালো অনুভূতি হয়
- খুব ক্লান্ত লাগে
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়
- ঘা হলে ধীরে ধীরে নিরাময় হয়
- স্বাভাবিকের চেয়ে সংক্রমণের হার বাড়ে
- খিটখিটে বোধ করা বা জলদি মেজাজ পরিবর্তন করা।
টাইপ 1 ডায়াবেটিস যেকোনো বয়সে শুরু হতে পারে। তবে এটি প্রায়শই শৈশব বা কিশোর বয়সে শুরু হয়। টাইপ 2, সবচেয়ে সাধারণ প্রকার, যে কোনো বয়সে হতে পারে। এই ধরনের ডায়াবেটিস 40 বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কিন্তু শিশুদের মধ্যে এটি বাড়ছে।
ডায়াবেটিস থেকে কী ধরনের জটিলতা হয়?
ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। রোগীর যত বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস থাকবে এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিত হবে, জটিলতার ঝুঁকি তত বেশি।
হৃদরোগের ঝুঁকি
ডায়াবেটিস প্রধানত অনেক হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এর মধ্যে বুকে ব্যথা (অ্যানজাইনা), হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ধমনী সরু হয়ে যাওয়া (অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস) রোগ হবার প্রবণতা বেশি। আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে আপনার হৃদরোগ বা স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
স্নায়ু রোগের ঝুঁকি
ডায়াবেটিস থেকে স্নায়ু রোগ (ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি) হয়। এতে ঝিমঝিম অনুভূতি, অসাড়তা, জ্বলন বা ব্যথার কারণ হতে পারে। যা সাধারণত পায়ের আঙ্গুল বা আঙ্গুলের ডগা থেকে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। হজমের সাথে সম্পর্কিত স্নায়ুর ক্ষতি বমি বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। পুরুষদের জন্য, এটি ইরেক্টাইল ডিসফাংশন হতে পারে।
চোখের ক্ষতি
ডায়াবেটিস থেকে চোখের ক্ষতি (ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি)। পায়ের স্নায়ুর ক্ষতি এবং অনেক জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। ত্বক এবং মুখের ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত সংক্রমণ সহ ত্বকের সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শ্রবণ সমস্যা বেশি দেখা যায়। আলঝেইমার রোগ, ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়াও বিষণ্নতা এবং হতাশার লক্ষণগুলো ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যাক্তিদের মধ্যে সাধারণত বেশি দেখা যায়।
ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা
১) রক্তে গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসক রোগীকে মুখে খাওয়ার মেডিসিন দিয়ে থাকেন।
২) রক্তে গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করতে চিকিৎসকেরা রোগীদের চামড়ার নিচে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন ব্যবহার করতে দিয়ে থাকেন।
৩) সুষম খাবার পরিকল্পনা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪) শারীরিক কার্যকলাপ ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত ব্যায়াম ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ডায়াবেটিস কি প্রতিরোধ করা সম্ভব?
টাইপ 1 ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যাবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যকর জীবনধারা প্রি ডায়াবেটিস, টাইপ 2 ডায়াবেটিস এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
১) স্বাস্থ্যকর খাবার খাবেন। চর্বি ও ক্যালোরি কম এবং ফাইবার বেশি এমন খাবার বেছে নিন। ফল, শাকসবজি এবং গোটা শস্যের খাবার তালিকায় রাখুন। একঘেয়ে ভাব এড়াতে বিভিন্ন রকমের খাবার খান।
২) নিয়মিত এক্সারসাইজ করুন। সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন প্রায় ৩০ মিনিটের মাঝারি অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করুন।
৩) অতিরিক্ত ওজন কমান। যদি আপনার ওজন বেশি হয়, তাহলে আপনার শরীরের ওজন কমানো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে পারে। কিন্তু গর্ভাবস্থায় ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না৷
৪) স্ট্রেস, উদ্বেগ থেকে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। এ কারণে স্ট্রেস কমাতে রিলাক্সেশন টেকনিক ফলো করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্রিদিং এক্সারসাইজ, মেডিটেশন ভালো কাজ করে।
৫) ধূমপান, অ্যালকোহল পান করা থেকে বিরত থাকুন।
৬) পর্যাপ্ত ঘুম (সাধারণত ৭ থেকে ৯ ঘন্টা) শরীরের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
আশা করি, ডায়াবেটিস কী, কত প্রকার এই নিয়ে আর কোনো কনফিউশন নেই। ডায়াবেটিস একটি ভয়ংকর রোগ। রোগীকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য এই রোগ সক্রিয়ভাবে কাজ করে। যেহেতু এই রোগের কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই তাই একটু সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। লাইফস্টাইলে কিছু পরিবর্তন আনলে এই রোগ কন্ট্রোলে নিয়ে আসা সম্ভব। তাই এই রোগ সম্পর্কে জানুন এবং নিজে সচেতন থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক।