ত্বক, চুল বা চোখের সমস্যা সরাসরি বোঝা যায় বলে ডাক্তারের কাছে গেলে চিকিৎসাও নেওয়া যায় সহজেই। কিন্তু কানের সমস্যা গুরুতর না হলে চিকিৎসার কথা কেউ তেমন একটা ভাবেন না। কানের অন্যান্য সমস্যার মতো ওয়াক্সও গুরুতর হতে পারে। কানের ওয়াক্স প্রচলিত ভাষায় কানের খৈল নামে পরিচিত। আজ আমরা জানবো কানের ওয়াক্স বা খৈল কী, কেন হয় এবং কখন, কীভাবে এর প্রতিকার করতে হবে সে সম্পর্কে।
কানের বিভিন্ন অংশ
সাধারণত কানকে আমরা তিনটি অংশে বিভক্ত করে থাকি।
১) বহিঃকর্ণ (কানের সরু পথ ও বাহিরের কিছু অংশের সমন্বয়)
২) মধ্যকর্ণ (মাঝের অংশ যা আমরা দেখি না)
৩) অন্তঃকর্ণ (একদম ভেতরের অংশ)
কানের যে অংশটুকু আমরা দেখতে পাই অর্থাৎ দৃশ্যমান সরু এবং তরুণাস্থি (cartilage) দ্বারা গঠিত অংশে এই ওয়াক্স থাকে।
কানের ওয়াক্স কী?
আমাদের শরীরে ছোট ছোট অনেকগুলো গ্রন্থি আছে যাদের কাজ হলো ক্রমাগতভাবে আমাদের শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় ও বর্জ্য পদার্থগুলো ঘাম, কিংবা তরল নিঃসরণের মাধ্যমে বের করে দেওয়া। কানের মধ্যে থাকা গ্রন্থিগুলো থেকে একধরণের আঠালো পদার্থ নির্গত হয় যার সাথে মরা চামড়া, আমাদের চারপাশে উড়তে থাকা ধূলিকণা মিশে যায়। একের পর এক স্তর জমতে জমতে ওয়াক্সে পরিণত হয়, পরে এগুলো খয়েরী রঙ ধারণ করে।
দেখতে কেমন?
ওয়াক্স মূলত সিবাসিয়াস গ্রন্থির ক্ষরণ। একে সেরুমেন বলে। এর মধ্যে কেরাটিন (৬০%), স্যাচুরেটেড এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (১২-২০%) এবং কোলেস্টেরল (৬-৯%) থাকে। ওয়াক্স অর্থাৎ কানের খৈলের রঙ সাধারণত হলদে- খয়েরী। কিন্তু বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কখনো কখনো কালো রঙ ধারণ করে। ওয়াক্স শক্ত হবে না অপেক্ষাকৃত নরম থাকবে তা নির্ভর করে সিবাসিয়াস গ্রন্থির নিঃসরণের উপর। নিঃসরণ কম হলে ওয়াক্স শক্ত হবে, বেশি হলে নরম হবে।
কীভাবে ওয়াক্স বের হয়?
যখন আমরা খাবার খাই কিংবা কথা বলি তখন মুখ নড়াচড়া করে। এই নড়াচড়াই ওয়াক্সের কানের ভেতর থাকা বা না থাকায় ভূমিকা পালন করে। এছাড়া হাঁচি, কাশি, গোসল, ঘুম ইত্যাদি নানা ধরনের জৈবিক কাজের মাধ্যমেও ওয়াক্স নিজে নিজেই বের হয়ে যায়। একদম জমে গেলে তখন বাইরে থেকে সাহায্য নিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। কিন্তু সেটাও করতে হবে সাবধানে এবং এক্সপার্ট কারো সাহায্যে।
কেন কানে ওয়াক্স জমে?
কানের ভেতর ওয়াক্স জমার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি কারণ হচ্ছেঃ
- সিবাসিয়াস গ্রন্থির অতিরিক্ত বা কম নিঃসরণ হওয়ার কারণে
- সেবোরিক ডার্মাটাইটিস নামক চর্মরোগ
- কানের ভেতর শক্ত লোম থাকলে
- এমনিতেই কানের দৃশ্যমান অংশটা সরু, যদি আরো বেশি সরু হয়ে যায়, তখন ওয়াক্স খুব দ্রুত জমে
- খুব ধুলাবালি যুক্ত পরিবেশে কাজ করলে
- শুকনো আর গরম আবহাওয়ার কারণে
উপকারিতা
কখনো কি মনে প্রশ্ন এসেছে, যে কানের খৈল আমরা পরিষ্কার করে ফেলছি সেটা কেন কানের ভেতর জমা হচ্ছে? এটা পরিষ্কার করা দরকারই বা কেন? এর উত্তর হচ্ছে, ওয়াক্সের কিছু উপকারিতা আছে। আর এজন্যই এগুলো কানের ভেতর জমে এবং সময়মতো একে পরিষ্কার করে ফেলতে হয়। ওয়াক্সের কারণে যে যে উপকার হয়ঃ
১) ওয়াক্স অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল অ্যাকশন নিতে পারে। যার কারণে কানের ভেতর যে কোনো ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে বাঁধা দেয়।
২) কানকে হাইড্রেটেড রাখে।
৩) কানের ভেতরকে ধুলোবালি থেকে রক্ষা করে।
ওয়াক্স বেশি হলে কী কী সমস্যা হতে পারে
যদি কানের ভেতর ওয়াক্স বেশি জমে যায় তবে বেশ কয়েক ধরনের সমস্যা হবে। যেমনঃ
- রোগীর কান বন্ধ হয়ে যাবে
- চুলকানি ও অস্বস্তি
- কান বন্ধ থাকার কারণে রোগী সব কথা শুনতে পারবে না
- কান ব্যথা
- ওয়াক্স জমার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে রোগী একটানা আওয়াজ শুনবেন এবং ক্রমাগত মাথা ঘোরাবে
চিকিৎসা
অনেকে ভাবেন, কানের খৈলের আবার চিকিৎসা কী? কিছু একটা দিয়ে পরিষ্কার করে নিলেই হবে। কিন্তু এই ভুল একদম করা যাবে না। সমস্যা বেড়ে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ওয়াক্স ক্লিন করার জন্য কয়েকটি উপায়ে চিকিৎসা দেওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছেঃ
১) সিরিঞ্জিং: কানের ভেতরের ওয়াক্স বের করার জন্য সিরিঞ্জিং পদ্ধতি অর্থাৎ সিরিঞ্জ ব্যবহার করা হয়। এটি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও সম্ভব নয়।
২) সাকশন অ্যান্ড ক্লিনিং (suction and cleaning): বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে কানের ভেতরে থাকা ওয়াক্স বাতাসের মাধ্যমে টেনে বের করে আনা হয় এ পদ্ধতিতে। তবে এক্ষেত্রে ওয়াক্স নরম হতে হবে, শক্ত হলে যন্ত্রে আটকে যাবে।
৩) হাত দিয়ে টেনে আনা: এছাড়াও হাত দিয়ে টেনে বের করে আনার জন্য বিভিন্ন যন্ত্র আছে যা দিয়ে চিকিৎসক অনায়াসে ওয়াক্স বের করে এনে রোগীকে আরাম বোধ করাতে পারেন।
বাচ্চাদের কানে ওয়াক্স হলে যেভাবে ক্লিন করতে হবে
বড়দের চেয়ে ছোট বাচ্চাদের কানে ওয়াক্স জমলে তার চিকিৎসা করা কিছুটা জটিল। চিকিৎসকেরা সাধারণত শিশুদের কানে হাত দিতে মানা করেন। এই নিষেধাজ্ঞার অন্যতম কারণ হচ্ছে, অসাবধানতায় অথবা আনাড়ি হাতে ওয়াক্স বের করতে গিয়ে শিশুর কানের ভেতরের পাতলা পর্দা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ছিঁড়ে যেতে পারে। একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সেটি আরও জটিল হয়ে যেতে পারে। এজন্য সমস্যা বোঝার সাথে সাথে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসাটাই চিকিৎসার প্রধান ধাপ।
বাচ্চা যতদিন নিজে না বুঝতে পারে, ততদিন বাচ্চাকে অভিভাবকের কোলে বসিয়ে, মাথাটা হালকা ধরে রাখতে হবে যেন স্বল্প সময়ের মধ্যে চিকিৎসক দ্রুত কানের ভেতর দেখে নিতে পারেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে পারেন।
বেশির ভাগ সময় শক্ত হয়ে যাওয়া ওয়াক্স নরম করার জন্য পাঁচ থেকে সাতদিন অলিভ অয়েল দিনে দুইবার করে দিতে বলা হয়। নরম হওয়ার পর উপরের যে কোনো এক পদ্ধতিতে বের করে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বাচ্চা যদি কোনোভাবেই স্থির না হয়, তখন খুব হালকা ডোজের এনেস্থেসিয়া দিয়ে অল্প সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে ওয়াক্স বের করে আনা হয়। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এটা চিকিৎসারই একটা পদ্ধতি।
ইয়ার বাডস ব্যবহারে সাবধানতা
অনেকেই কানের খৈল পরিষ্কার করার জন্য বাডস ব্যবহার করেন। কিন্তু এই ধরনের জিনিসগুলো ঘন ঘন ব্যবহার করা একদম উচিত নয়।
কেন এই বাডসগুলো ব্যবহার করা যাবে না?
১) কানের ছিদ্রের চেয়ে বাডসের ব্যাস বড়। তাই বের হওয়ার বদলে ওয়াক্স আরও ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। এ থেকে সংক্রমণও হতে পারে। এছাড়া বাডসের তুলো থেকেও সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২) কানের প্রাচীরে আঘাত লাগা বা বাডস ভেঙে ভেতরে ঢুকে যেতে পারে।
৩) বারবার খোঁচাখুঁচি করার কারণে কানের তরুণাস্থি নষ্ট হয়ে শ্রবণশক্তি দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
ওয়াক্স খুব সাধারণ একটি বিষয়। পরিষ্কার করার জন্য কানে বারবার খোঁচাখুঁচি করলেই বরং কানের ক্ষতি হতে পারে। যদি ওয়াক্স বেশি জমে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। নিজের যত্ন নিন। সাবধানে থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ছবিঃ সাটারস্টক