গর্ভাবস্থা একজন হবু মা এবং তার পুরো পরিবারের জন্য একটি স্বপ্নীল অধ্যায়। সব হবু মা-বাবাই চান তাদের একটি সুস্থ, স্বাভাবিক সন্তানের জন্ম হোক। তাই পুরো প্রেগনেন্সি পিরিয়ড জুড়েই চলে বিভিন্নরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা। অ্যানোমালি স্ক্যানও তার মধ্যে একটি। আসুন জেনে নেই এই অ্যানোমালি স্ক্যান সম্পর্কে বিস্তারিত।
অ্যানোমালি স্ক্যান কী?
Anomaly scan সম্পর্কে প্রেগনেন্ট নারীদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেওয়া জরুরি। অ্যানোমালি স্ক্যান এক ধরনের আধুনিক আলট্রাসনোগ্রাফি যার মাধ্যমে সাধারণ আলট্রাসনোগ্রাফি থেকে আরও উন্নত ও স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পাওয়া সম্ভব। এটি Ultrasound level 2 নামেও পরিচিত। সাধারণত গর্ভাবস্থায় ১৮ সপ্তাহের পর থেকে ২৪ সপ্তাহের মধ্যে এটি করতে হয়। এটি সকল গর্ভবতী মাকেই করতে উপদেশ দেয়া হয়। তবে কেউ চাইলে এ পরীক্ষা নাও করতে পারেন। এই স্ক্যান করার মূল উদ্দেশ্য হলো গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা বা কোনো শারীরিক ত্রুটি আছে কিনা তা খুঁটিয়ে দেখা। বেশ কিছু শারীরিক ত্রুটি অ্যানোমালি স্ক্যানে ধরা পড়ে যা সাধারণ আলট্রাসাউন্ডে ধরা পড়ে না। বাচ্চার লিঙ্গ বা জেন্ডার সম্পর্কেও এই স্ক্যান এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।
অ্যানোমালি স্ক্যান এ যে সমস্ত ত্রুটি ধরা পড়ে
এই স্ক্যান এর মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশুর ব্রেইন, স্পাইনাল কর্ড, মুখের গঠন, হাড়, কিডনি এবং পেটের মধ্যকার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। যেমন:
এনেনকেফালি
এটি এমন একটি জন্মগত ত্রুটি যেখানে শিশুর ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ডের গঠন ঠিকমতো হয় না। এক্ষেত্রে শিশুর মস্তিষ্ক এবং মাথার খুলির একটি বড় অংশই অনুপস্থিত থাকে বা গঠনই হয় না। শিশুর মুখ এবং ঘাড়ও কিছুটা বিকৃত থাকে। এটি এমনই সিরিয়াস কন্ডিশন যার কোনো চিকিৎসা নেই এবং এ ধরনের শিশু জন্ম নিলেও বেশিক্ষণ বাঁচে না।
নিউরাল টিউব ডিফেক্ট বা স্পাইনা বাইফিডা
এক্ষেত্রে ভ্রূণের স্পাইনাল কর্ডের গঠন ঠিকমতো হয় না। এটি গর্ভাবস্থার একদম প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটে, এমনকি এ সময় গর্ভবতী নিজেও বুঝতে পারেন না যে তিনি গর্ভধারণ করেছেন।
ক্লেফট লিপ বা তালু কাটা
বাচ্চার ঠোঁট বা তালু কাটা আছে কি না তা এই স্ক্যানের মাধ্যমে দেখা যায়।
ডায়াফ্রাগম্যাটিক হার্ণিয়া
এই ক্ষেত্রে বুকের মধ্যচ্ছদা পর্দার গঠন ঠিকমতো হয় না। এই পর্দা হার্ট এবং লাংসকে পেটের মধ্যকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে। ঠিকমতো গঠন না হওয়ার ফলে বা ছিদ্র থাকার ফলে পেটের মধ্যস্থ অন্ত্র বুকের ভেতর চলে আসে। এই অবস্থায় বাচ্চা জন্ম নিলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
হৃদযন্ত্রের পরীক্ষা
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর হার্টের চারটি প্রকোষ্ঠ ঠিকমতো গঠন হয়েছে কিনা এবং ঠিকমত কাজ করছে কিনা সে সম্পর্কে এই স্ক্যান থেকে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়।
গ্যাস্ট্রোস্কিসিস
এই জন্মগত ত্রুটির ফলে শিশুর পেটের মাসল বা চামড়া ঠিকমত গঠন হয় না এবং যার ফলে অন্ত্র বা পেটের অঙ্গগুলি শরীর থেকে বের হয়ে পেটের উপর অবস্থান করে।
বাইল্যাটারাল রেনাল এজেনেসিস
এটি একটি রেয়ার কন্ডিশন যেখানে বাচ্চার উভয় কিডনি অথবা একটি কিডনি পরিপূর্ণভাবে গঠন হয় না। এছাড়াও এ পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চার মূত্রথলির গঠন এবং সেখানে মূত্র বিনা বাধায় পৌঁছাতে পারছে কিনা তাও নির্ণয় করা যায়।
গুরুতর হাড়ের বিকৃতি
শিশুর শারীরিক গঠনে হাড়ে বা অন্য কোনো মেজর বিকলাঙ্গতা আছে কিনা তা এই স্ক্যানের মাধ্যমে বোঝা যায়।
জেনেটিক ডিফেক্ট
বাচ্চার নাকের হাড়ের গঠন বা অনুপস্থিতি দেখে তার কোনো জেনেটিক ডিফেক্ট বা ক্রোমোজমাল অ্যাবনর্মালিটি আছে কিনা তা বোঝা যায়।
এক্সোমফ্যালোস বা ওমফ্যালোসিল
এটিও শিশুর পেটের মাসলজনিত জন্মগত ত্রুটি, যার ফলে নবজাতকের নাড়ীর একটি অংশ এবং অধিকাংশ সময়ে লিভার ও পেটের ভেতরের অন্যান্য অংশ নাভীর মধ্য দিয়ে বাইরে চলে আসে এবং এটি একটি থলের মধ্যে থাকে। থলেটি একটি পাতলা পর্দা দিয়ে তৈরি এবং এই পাতলা পর্দার ভেতর দিয়ে ভেতরের নাড়ীগুলি স্পষ্ট দেখা যায়।
এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জন্মগত ত্রুটি যা নিরাময় করা কষ্টসাধ্য এমনকি অনেক সময় যা নবজাতকের প্রাণনাশেরও কারণ হতে পারে সে সম্পর্কে এই অ্যানোমালি স্ক্যান থেকে ধারণা পাওয়া যায়। এটি একটি সম্পূর্ণ ব্যথা মুক্ত প্রক্রিয়া। স্ক্যানে ধরা পড়েছে এমন কিছু কিছু সমস্যার অর্থ হলো যে শিশুটির জন্মের পরেই সমস্যাগুলোর জন্য চিকিৎসা বা সার্জারির দরকার হতে পারে। কিছু কিছু বিরল ক্ষেত্রে দেখা যায় যে সমস্যাটির কোনো চিকিৎসা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে শিশুটি জন্মের পরপরই বা গর্ভে থাকা অবস্থাতেই মারা যায়। কোনো সমস্যা দেখা গেলে নিরাশ না হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। অ্যানোমালি স্ক্যান আমাদের দেশে সব জায়গায় সহজলভ্য নয়। তবে এ প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে জানার পর কেউ যদি গর্ভস্থ শিশুর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পরীক্ষাটি করাতে চান তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে তা করাতে পারেন।
ছবিঃ সাটারস্টক