হাঁটিহাঁটি পা পা করে আসছে শীত। হিম হিম শীতল এই ছোঁয়া শরীরের জন্য আরামদায়ক হলেও ত্বকের জন্য নয়। শীতের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে নানা রকম ত্বকের সমস্যা। বিশেষ করে শুষ্ক ত্বকের জন্য শীত যেন এক দুঃস্বপ্ন। তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারীরা অতিরিক্ত তেল থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেও মুখ ধোয়ার পর পরই ত্বকে দেখা যায় শুষ্ক টান টান ভাব। অতিরিক্ত শুষ্কতা ত্বকে খুব দ্রুত বলিরেখা তৈরি করে ও শুষ্ক মৃত কোষ ত্বক কে কালো দেখায়। তাই সব ধরনের ত্বকেই শীতে প্রয়োজন একটু বাড়তি যত্ন। আসুন জেনে নিই কীভাবে নেবেন শীতে ত্বকের পরিপূর্ণ যত্ন।
ক্লিঞ্জিং
শীতে ত্বক পরিষ্কার করতে বেছে নিন মাইল্ড ও কম ক্ষারযুক্ত ফেসওয়াশ, যা ত্বক কে অতিরিক্ত শুষ্ক করবে না ও আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করবে। মুখে সাবান ব্যবহার করবেন না একদমই। সারা শরীর পরিষ্কার করতেও সাবানের বদলে বেছে নিন শাওয়ার জেল। দিনে ২-৩ বারের বেশি মুখ ধোবেন না। এতে ত্বক প্রাকৃতিক আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে।
স্ক্রাবিং
শীতের শুষ্ক আবহাওয়া ত্বক থেকে আর্দ্রতা শুষে নেয়। ফলে ত্বক হয়ে পরে শুষ্ক ও খসখসে। ত্বকে জমে মৃতকোষ। বাড়ে ব্ল্যাক হেডস ও হোয়াইট হেডস। এসব থেকে বাঁচতে স্ক্রাবিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তাহে ২-৩ দিন স্ক্রাবিং করুন। বাজারে প্রচলিত স্ক্রাব ব্যবহার করতে না চাইলে বাসায় তৈরি করে ফেলতে পারেন স্ক্রাব। ২ চা চামচ চালের গুঁড়োর সাথে ২ চা চামচ টক দই ও মধু মিশিয়ে স্ক্রাব তৈরি করুন।
টোনিং
টোনিং জন্য বেছে নিন অ্যালকোহল ফ্রি টোনার। টোনার ত্বকের PH ব্যালেন্স ঠিক রাখে ও ময়েশ্চারাইজার বা ফাউন্ডেশনকে লোমকূপের মুখ বন্ধ করতে বাঁধা দেয়।
ময়েশ্চারাইজেশনঃ
শীতে ত্বক সুরক্ষার প্রধান উপায় হলো ত্বকের পর্যাপ্ত ময়েশ্চাইরেশন। শীতের শুষ্কতা ত্বক থেকে আর্দ্রতা শুষে নেয়। ফলে ত্বক হয়ে পরে শুষ্ক ও রুক্ষ। ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে গোসল /মুখ ধোয়ার পর ভেজা ভাব থাকতেই ত্বকে লাগান ক্রিম /লোশন। ওয়াটার বেসড ক্রিম /লোশনের বদলে বেছে নিন অয়েল বেসড ক্রিম/লোশন।
রাতে ত্বকের বাড়তি সুরক্ষায় করুন ডিপ কন্ডিশনিং। আপনার পছন্দের যেকোনো তেল যেমন আমন্ড অয়েল, অলিভ অয়েলের সাথে মেশান ভিটামিন ই অয়েল (ভিটামিন ই ক্যাপসূল আকারে ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়)। একসাথে মিলিয়ে মুখে ম্যাসাজ করুন। আমন্ড অয়েল /অলিভ অয়েল ও ভিটামিন ই ত্বক নরম রাখতে ও ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ফেসপ্যাকঃ
গরমের দিনে যেসব অয়েল কন্ট্রলিং ফেসপ্যাক ব্যবহার করেছেন, শীতে সেগুলো ব্যবহার করা যাবেনা একদমই। তাহলে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে ফেটে যাবে। ত্বকে ব্যবহার করুন এমন ফেসপ্যাক যা ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে ও ত্বক নরম ও কোমল রাখতে সাহায্য করবে।
শীতে সব ধরনের ত্বকের উপযোগী কিছু ফেসপ্যাকঃ
পাকা কলার পেষ্ট+মধু+আমন্ড অয়েল
পাকা পেঁপে+মধু+টক দই
কোকো পাউডার+টক দই+মধু
ঠোঁটের যত্নঃ
শরীরের অন্য যেকোনো অংশের চেয়ে ঠোঁটের ত্বক অত্যন্ত পাতলা ও সংবেদনশীল। শীতে ঠোঁট খুব সহজেই আর্দ্রতা হারিয়ে শুকনো খরখরে হয়ে যায়, ফেটেও যায়। ঠোঁটের আর্দ্রতা বজায় রাখতে ঠোঁটে লাগান চ্যাপস্টিক /লিপবাম। Brut’s bee, aquafina, nivea lip therapy, maybelline baby lips, The body shop shea chap stick ভালো মানের চ্যাপস্টিকের মধ্যে অন্যতম। চ্যাপস্টিক বা লিপবাম সাথে রাখুন সবসময়। ভুলেও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাবেন না। এতে ঠোঁট আরও শুষ্ক হয়ে ফেটে যাবে।
সপ্তাহে ২ দিন ঠোঁটে লাগান বাড়িতে তৈরি লিপস্ক্রাব। এজন্য ১ চা চামচ চিনি, ১/২ চা চামচ লেবুর রস ও ১/২ চা চামচ মধু মিশিয়ে ঠোঁট আলতো ভাবে ঘষুন। মরা চামড়া উঠে গিয়ে ঠোঁট পরিষ্কার হয়ে যাবে।
হাত ও পায়ের যত্নঃ
গোসলের পর ভেজা থাকতেই হাত পায়ে লাগান লোশন বা বডি বাটার। এই শীতে হাত পায়ের ত্বক সুরক্ষায় বডি বাটার খুবই উপকারী। যাদের ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক তারা লোশনের সাথে মিশিয়ে নিন আমন্ড অয়েল /অলিভ অয়েল /বেবি অয়েল।
– সপ্তাহে ২-৩ দিন ব্যবহার করুন বডি স্ক্রাব। বাজারে পাওয়া যায় হাত পায়ের যত্নে বিশেষ স্ক্রাবও।
– যাদের শীত এলেই পা ফাটে, তারা সপ্তাহে একদিন বাড়িতেই পেডিকিউর করুন।
– উষ্ণ গরম পানিতে পা কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে পিউমিস স্টোন বা বাফার দিয়ে ঘষে মরা চামড়া তুলে ফেলুন। তারপর গোড়ালিতে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। গোড়ালির সুরক্ষায় নানা রকম ফুট ক্রিমও পাওয়া যায়।
– রাতে পায়ে পুরু করে ভ্যাসলিন মেখে মোজা পরে ঘুমান। তাহলে আর পা ফাটবে না।
সানস্ক্রিনঃ
অনেকেই ভাবেন শীতে বুঝি সানস্ক্রিন লাগানোর প্রয়োজন নেই। এটি একদম ভুল ধারনা। বাইরে বের হওয়ার ৩০ মিনিট আগে অবশ্যই সানস্ক্রিন লাগাতে হবে। কারণ শীতের রোদে UVA UVB আরও বেশি মাত্রায় থাকে। ব্যবহার করুন broard spectrum ও SPF 30 যুক্ত সানস্ক্রিন।
শীতে মেক-আপঃ
শীত হলো মেক-আপ করার আদর্শ সময়। কারণ শীতে মেক-আপ গলে তেল চিটচিটে হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। এই শীতে গাঢ় আর কালারফুল মেক-আপে সাজিয়ে তুলুন নিজেকে। তবে মেক-আপ করার আগে ত্বকে পর্যাপ্ত ময়েশ্চারাইজার লাগাতে ভুলবেন না আর গরমে ব্যবহার করা ম্যাট ফাউন্ডেশনের বদলে ব্যবহার করুন অয়েল বেসড ফাউন্ডেশন। লিপস্টিকের বদলে লাগান লিপগ্লস।
এই শীতে যা করবেনঃ
শীতের শুষ্ক আবহাওয়া শরীর থেকে পানি শুষে নেয়। তাই ভেতর থেকে শরীরকে আর্দ্র রাখা খুব জরুরী। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।
খাদ্য তালিকায় যোগ করুন শীতের ফলমূল ও সবজি – টমেটো, গাজর, ফুলকপি, কমলা এগুলো ভিটামিন সি এর ভালো উৎস। যা ত্বকের ইলাস্টিসিটি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
যা করবেন নাঃ
ঠোঁটে পেট্রোলিয়াম জেলী /ভ্যাসলিন না লাগানোই ভালো। দীর্ঘদিন ব্যবহারে ঠোঁট কালো করে ফেলে।
যতই আরাম লাগুক অতিরিক্ত গরম পানিতে গোসল না করাই ভালো। এতে ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে পরে। করতে চাইলে গরম পানিতে আপনার পছন্দের তেল কয়েক ফোঁটা মিশিয়ে নিন।
পুরোপুরি শীত নামতে এখনো কিছু দেরি থাকলেও ত্বকের যত্ন নিন এখন থেকেই। এই শীতেও থাকুন সজীব ও উজ্জ্বল। উপভোগ করুন শীতকে।
লিখেছেনঃ মৌসুমী তানিয়া
ছবিঃ শিনোজ.কো.ইউকে