আমার ভাইয়ের মেয়ের বয়স আড়াই বছর। কিন্তু তার হাতে মোবাইল না দিলে তাকে কিছু খাওয়ানো যায় না। দিনে যতটা সময় সে জেগে থাকে তার সারাটাক্ষণই সে মোবাইল বা ট্যাবলেট নিয়ে থাকে। আমার বোনের ছেলেটির বয়স ৫বছর। তাকে কখনই দেখলাম না সে বাইরে খেলতে যাওয়ার জন্য বায়না করছে। এই বয়সের বাচ্চারা কিন্তু খেলাধূলার জন্য কান্নাকাটি করতো। শপিংয়ে নিয়ে গেলে তাকে কখনো খেলনার দোকানের সামনে দেখা যায় না। তার আকর্ষন থাকে বিভিন্ন ডিভাইসের শোরুমে। ঘটনাগুলো খুব পরিচিত মনে হচ্ছে নিশ্চয়? এটি শুধু আমার বাড়ির ছবি নয়। সবার ঘরেরই মোটামুটি একইরকম অবস্থা। এগুলোই মূলত শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি হওয়ার প্রথম লক্ষণ।
শিশুর সুন্দর গোল চোখ জোড়া সারাক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে আছে, তা দেখতে আমাদের কারোরই ভাল লাগে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের টেকনোলজি আসক্তির কারণে শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ সঠিকভাবে হয় না, সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারে না, একাকীত্বে ভোগে। সারাক্ষণ বসে থাকার কারণে তাদের ফ্যাট বার্ন হয় না। যার ফলে অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তাছাড়া মোবাইলের রেডিয়েশন ক্যান্সার সৃষ্টি করে। যাদের সন্তান এখনও মোবাইল, আইপ্যাড, ট্যাবলেট এসবের প্রতি আসক্ত হয় নি তারা আজই সতর্ক হোন। আর যাদের শিশুটি আসক্ত হয়েই গিয়েছে কিছু ছোট ছোট কাজ করে ধীরে ধীরে শিশুর এই টেকনোলজি আসক্তি কমান। কারণ একদিনের চেষ্টায় এটি দূর করা কখনওই সম্ভব নয়। তাই আজকে আমরা আপনাদের জানাবো শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি দূর করার কার্যকরী উপায়।
শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি দূর করার উপায়
(১) শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি দূরে শিশুর জন্য সময় বের করুন
এখনকার বাবা মা দুইজনই এতটা ব্যস্ত থাকেন যে তারা সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। সেই সকাল বেলা কাজে চলে যাওয়া, দিন শেষে বাসায় এসে শিশুর বায়না বা কান্না থামানোর মতো মানসিক অবস্থা থাকে না। তখন দেখা যায়, শিশুটি গেমস খেলে বা নানারকম ভিডিও দেখে সময় কাটায়। এভাবেই কিন্তু আপনার সন্তানটি টেকনোলজির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাই সন্তানের জন্য সময় বের করুন। কিছুটা সময় তার সাথে গল্প করুন, দিনের নানা রকম কথা বলুন, তাকে নিয়ে ঘুরতে যান। তা সম্ভব না হলে অন্তত বাসার বাইরে বা ছাদে গিয়ে হেটে আসুন। এভাবে সময় দিলে শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি কমে যাবে।
(২) শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি দূরে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখুন
শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি এর আরেকটি ক্ষতিকর দিক হলো তারা নিজেদের সৃজনশীল গুণগুলো চিনতেই পারে না। ছোট থেকেই তাদের বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ যেমন পেইন্টিং, নাচ, গান এসবে আকৃষ্ট করে তুলুন। আপনি কাজে ব্যস্ত। কাজের সময় বাচ্চাটিকে ব্যস্ত রাখার জন্য তাকে মোবাইল বা ট্যাবলেট দিয়ে বসিয়ে দিলেন। ক্ষতির শুরুটা কিন্তু এখানেই। এই সময়টাতে তাকে যদি আপনি রং তুলি দিয়ে বসিয়ে দেন দেখবেন সে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে আর আপনার কাজের ও ক্ষতি হবে না।
(৩) বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করুন
আমরা প্রথমেই যে ভুলটি করি তা হলো, শিশু যখন বুঝতে শুরু করে তখন অনেক বাবা-মা খেলার জন্য তার হাতে মোবাইল তুলে দেয়। কিন্তু এই সময়টাতে তাকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেন। সুন্দর ছবিসহ বইগুলো দেখান, গল্প পড়ে শোনান। তাহলে আর শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি হবে না।
(৪) আউটডোর গেমসের প্রতি আকৃষ্ট করা
যেসব শিশুরা টেকনোলজি এডিকটেড খেয়াল করে দেখবেন তারা কোনরকম খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। তাই বাচ্চাদের ছোট থেকেই বাইরে খেলতে নিয়ে যাওয়া উচিত। আপনি চাইলে আপনার সন্তানকে কোন স্পোর্টস ক্লাবে ভর্তি করাতে পারেন। অন্য বাচ্চাদের সাথে বাইরে খেলাধূলা করলে সে নিজেও এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
(৫) শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি দূরে সন্তানের জন্য উদাহরণ হোন
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, জানেন তো? আপনাকে কিন্তু অনুকরণ করে আপনার সন্তানই। সন্তানের সামনে সারাক্ষণ মোবাইলে বা ল্যাপটপে কাজ করতে থাকলে আপনার শিশুটিও তাই শিখবে। তাই যতটা সম্ভব চেষ্টা করুন অফিসের কাজ অফিসে শেষ করে আসার। আপনার শিশুর জন্য অন্য কেউ নয়, আপনি নিজেই একজন উদাহরণ হোন।
(৬) পরিবারের সাথে সময় কাটানো শেখান
আমার পরিবারের একটি নিয়ম ছিল। যে যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন রাতে খাবারের সময়টাতে সবার একসাথে টেবিলে বসে খেতে হবে। আর আমার বাবা শিখিয়েছিলেন খাবার টেবিলে সবাই সবার কথা বলবে এবং কেউ আমাদের সাথে কথা বললে তার সাথে চোখে চোখে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। সহজ ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি “Eye Contact”। এখন আমি বুঝতে পারি, মানুষের সাথে সহজেই মেশার ক্ষমতা কিন্তু পরিবার থেকেই শেখা শুরু হয়। পরিবারের একজনের প্রতি আরেকজনের বন্ধন কিন্তু এমনি-এমনি দৃঢ় হয় না। এসব কাজের মাধ্যমেই কিন্তু হয়। এখনকার দিনে এই ব্যাপারটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাই সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। আমাদের শিশুদের কিন্তু এসব শেখানোর দ্বায়িত্ব আমাদেরই।
(৭) সময় বেঁধে দিন
টেকনোলজির প্রতি আসক্ত সন্তানকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন। তাকে বলুন ছুটির দিনে বা সপ্তাহে এক থেকে দুইবার সে গেমস খেলতে পারবে। কিন্তু তা যাতে অবশ্যই ১ ঘন্টার বেশি না হয়।
(৮) শিশুদের টেকনোলজিতে আসক্তি দূরে হোমওয়ার্ক আগে দরকার
আপনার সন্তানকে তার পড়ালেখা ও বাড়ির কাজের গুরুত্ব বোঝান। সে অন্য কিছু করার আগে তার হোমওয়ার্ক আগে শেষ করতে হবে এই জিনিসটি শেখান। দেখবেন সে মোবাইলটি হাতে নেয়ার আগে তার হোমওয়ার্কের কথা ভাবছেন।
কয়েকদিন আগে একটি নিউজ পড়লাম। সেটি ছিল এমন, প্রিন্স উইলিয়ামস ও কেইট মিডল্টন তাদের দুই সন্তানকে সাধারণভাবে বড় করে তুলতে চান। এর মানে হলো কোন রকম স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও অন্যান্য ইন্টারনেট কানেক্টেড ডিভাইস ছাড়া তাঁদের সন্তানরা বেড়ে উঠুক। তাঁরা চায় তাঁদের সন্তানরা খেলনা নিয়ে খেলুক, বাইরে খেলাধূলা করুক ও নিজের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা কাজে লাগাক।
একটু ভেবে দেখুন, প্রিন্স উইলিয়ামস এত রাজকীয় বংশের হয়েও এইভাবে ভাবছেন। আমাদেরও আমাদের শিশুদের নিয়ে ভাবা দরকার। টেকনোলজিকে বর্তমানে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। কিন্তু এর সাথে সাথে আমাদের শিশুদের কীভাবে সামাজিক হওয়া যায়, পরিবারের সাথে সময় কাটানো, খেলাধুলা করা, তাদের নানারকম গুণ আমাদেরই বের করে আনতে হবে। টেকনোলজী দরকার কিন্তু তা যাতে আসক্তিতে পরিণত না হয়। এর ফলাফল কখনোই সুখকর হয় না।
ছবি- সংগৃহীত: beaches, সাটারস্টক