অ্যালার্জি কেন হয় এবং কীভাবে বুঝবেন আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন কিনা?

অ্যালার্জি কেন হয় এবং কীভাবে বুঝবেন আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন কিনা?

allergy 1

ফুলের গন্ধ নিচ্ছেন? ঘরের ধুলাবালি পরিষ্কার করছেন?- হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেলো একের পর এক হাঁচি, সাথে শ্বাসকষ্ট। দুপুরে জমিয়ে খেতে বসেছেন? চিংড়ি, ইলিশ, গরুর মাংস বা দুধ দিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছেন? খাওয়ার সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো গা চুলকানি বা চামড়ায় লাল লাল চাকা হয়ে ফুলে ওঠা। রাতে মশারী টানাতে ভুলে গিয়েছেন?- উফফফ! মশার যন্ত্রণায় আর বাঁচা যায় না। পরদিন সকালে উঠে দেখলেন সমস্ত শরীরে মশার কামড়ের দাগের সাথে লাল লাল চাকা। এই যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এই সবকিছুর পিছনে অ্যালার্জি দায়ী। অ্যালার্জি কেন হয় এবং কীভাবে বুঝবেন আপনিও এই সমস্যায় ভুগছেন কিনা তাই জানাবো আজকের আর্টিকেলে।

অ্যালার্জি কেন হয়?

অ্যালার্জি হলো বডির ইমিউন সিস্টেমের একটি ওভার সেনসিটিভ বা অতিসংবেদনশীল দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা। এক্ষেত্রে পরিবেশে বিদ্যমান কোনো অ্যালার্জেনের কারণে শরীরে আনএক্সপেক্টেড ডিস্টার্বিং রিয়্যাকশন দেখা যায়। অ্যালার্জি হওয়া কিংবা না হওয়া সাধারণত আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

অ্যালার্জি কেন হয়

শরীরের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবেশের নানা উপাদান, যেমন- পরজীবী, ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু কখনো কখনো স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়াটিই জেনেটিক ত্রুটির কারণে অস্বাভাবিক, অতিসংবেদনশীল কিংবা অপ্রত্যাশিত হয়ে পড়ে- দেখা দেয় অ্যালার্জি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যক্তির শরীর আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর নয় এমন অনেক ধরনের বস্তুকেও ক্ষতিকর ভেবে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। সাধারণত ক্ষতিকর নয় এমন সব বস্তুর প্রতি শরীরের অতিসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়াকে অ্যালার্জি বলা হয়।

অ্যালার্জেন ও অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া কী?

অ্যালার্জি নিয়ে বুঝতে গেলে প্রথমেই জানা জরুরি অ্যালার্জেন ও অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া কী। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক-

অ্যালার্জেন

যদি কোনো বস্তু বা পরিবেশের উপাদান কোনো মানুষের শরীরে অপ্রত্যাশিত মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায় তাহলে ঐসব বস্ত বা উপাদনসমূহ মানুষের জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে। মাইট, মোল্ড, পরাগরেণু, ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়া, ঘরের ধুলাময়লা, বহুবিধ খাদ্যদ্রব্য, পোষা প্রাণীর পশম বা চুল, পোকামাকড়ের কামড়, ওষুধসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, রাবার বা ল্যাটেক্স, কোনো কোনো প্রসাধনসামগ্রী বা উগ্র সুগন্ধী অ্যালার্জেন হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

খাবারে অ্যালার্জি

অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া

কোনো বস্তু কারও কারও জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করলেও অন্যদের ক্ষেত্রে ঐ একই বস্তু অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ নাও করতে পারে। এটি ব্যক্তিবিশেষের ইমিউন সিস্টেমের ভিন্নতার উপরে নির্ভর করে। আর কোনো অ্যালার্জেন শরীরের সংস্পর্শে এলে শরীরে যেসব অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তাকে বলে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া। চিকিৎসা শাস্ত্রে একে টাইপ-১ হাইপারসেনসিটিভিটি রিয়্যাকশনও বলে।

অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়ার ধরন

শরীরের কোন অংশ অ্যালার্জেন এর সংস্পর্শে আসে তার উপর ভিত্তি করে শরীরে বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যেমন-

অ্যালার্জিক রাইনাইটি

অনেক সময় দেখা যায় বৃষ্টিতে ভিজলে, পুকুরে গোসল করলে, ধুলোবালিতে গেলে, ফুলের পরাগরেণু নাকের ভিতরে গেলে, একটু ঠান্ডা লাগলেই বা কোনো ঠান্ডা পানীয় পান করলে কারও কারও সর্দি-কাশি শুরু হয়ে যায়। যাকে সাধারণভাবে আমরা ঠান্ডা লাগা বলে চিনি। সবারই কিন্তু এসবের সংস্পর্শে আসলে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। অর্থাৎ একই কাজগুলো অন্যরা করলে তাদের কিছুই হয় না। তাহলে এটা পরিষ্কার যে বৃষ্টির পানি, ধুলোবালি, পুকুরের পানি, ঠান্ডা পানি কিংবা পানীয় ইত্যাদি কারও জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে, আবার কারও কারও জন্য এটা স্বাভাবিক আর দশটা পরিবেশের উপদান হিসেবেই বিরাজ করে। এই স্বাভাবিক বস্তুগুলো যাদের জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে সর্দি-কাশি উৎপন্ন করে, তাদের শরীরে দেখা যায় অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বা অ্যালার্জিজনিত নাসাগহ্বরের প্রদাহ।

অ্যালার্জি কেন হয়

অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে সাধারণত শ্বাসযন্ত্রের মিউকাস পর্দা আক্রান্ত হয় এবং হিস্টামিন নামক রাসায়নিকের প্রভাবে আক্রান্ত মিউকাস পর্দা থেকে প্রচুর পরিমাণ মিউকাস ক্ষরিত হয়। এছাড়া প্রদাহের কারণে শ্বাসযন্ত্রে লিউকোট্রিন নামক এক ধরনের জৈব-রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয় যা কাশি তৈরিতে শ্বাসযন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করে। এজন্য নাক দিয়ে পানি পড়া তথা ঘন ঘন হাঁচি কিংবা সর্দি-কাশি, সঙ্গে প্রদাহজনিত কারণে শরীরে হালকা জ্বর থাকা, নাক চুলকানো, নাকে বন্ধভাব বোধ করা- এসব কিছুই অ্যালার্জিক রাইনাইটিসের কারণে হয়ে থাকে।

অনেক সময় রাইনোভাইরাস নামক সর্দি-কাশি উৎপন্নকারী এক ধরনের ভাইরাসও অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে। শীতকালের মতো বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে একে সিজনাল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়। আর সারা বছর ধরে হলে একে পেরিনিয়াল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষণসমূহ কম তীব্র হলেও এর স্থায়িত্ব হয় বেশি।

ফুড অ্যালার্জি

অনেকের গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, দুধ, হাঁসের ডিম, চীনাবাদামসহ বিভিন্ন ধরনের বাদাম, তিল, বেগুন, মাশরুম, খোলসযুক্ত মাছ যেমন- চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি বা বাইরের কোনো খাবার খেলেই শরীরে চুলকানি শুরু হয়ে যায়, চামড়ায় লাল লাল গোটা ওঠে কিংবা বমি বমি ভাব হয়, এমনকি বমি বা ডায়রিয়াও হয়। এগুলো মূলত অ্যালার্জির কারণে হয়ে থাকে। একে বলা হয় ফুড অ্যালার্জি। ঐ সমস্ত ব্যক্তির শরীর এ সকল খাবারের জন্য উপযোগী নয়। এই খাবার অন্যদের জন্য স্বাভাবিক হলেও বিশেষ জেনেটিক গঠনের কারণে ঐ ব্যক্তিদের জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে।

অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস

চোখের সাদা অংশ কোনো অ্যালার্জেনের সংস্পর্শে আসলে চোখ লাল হয়ে যায়, চোখ থেকে পানি ঝরে, চুলকায় এমনকি ব্যথাও করে। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যায়। অনেক সময় পুকুরে গোসল করলে বা খেলাধুলা করলে কিংবা বাইরে চলাফেরা করলেও কোনো কোনো শিশুর অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস বা চোখে অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা যায়।

অ্যালার্জি কেন হয়

ড্রাগ অ্যালার্জি

কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা কোনো ধরনের ওষুধ বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক (পেনিসিলিন কিংবা সেফালোস্পোরিন) গ্রহণ করার পরে তাদের শরীরে চুলকানি হয়ে চামড়া লাল হয়ে যায়। কোনো ওষুধ ব্যবহারের ফলে যদি কোনো ধরনের অস্বাভাবিক অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া শুরু হয় তবে সেটিকে ড্রাগ অ্যালার্জি বলা হয়। যদি কারও এমন হয় তাহলে তাকে অ্যালার্জেন ওষুধ পরিবর্তন করে অন্য ধরনের ওষুধ সেবন করতে হবে।

অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিস

মশা, ছারপোকা বা অন্য কোনো পতঙ্গ কামড় দিলে বা যদি এমন কোনো ধরনের বস্তুর সংস্পর্শে আসলে শরীরের ঐ অংশে যদি ফুলে লাল চাকা হয়ে প্রচন্ড চুলকানি তৈরি হয় (আর্টিকেরিয়া) তাহলে এ অবস্থাকে বলে অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিস। কোনো কোনো প্রসাধনী দ্রব্যও অনেকের শরীরে এ ধরনের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। সাধারণত স্বল্পস্থায়ী আর্টিকেরিয়া শিশুদের মধ্যে এবং দীর্ঘস্থায়ী আর্টিকেরিয়া বড়দের মধ্যে দেখা যায়।

অ্যানাফাইলেকটিক শক

যেকোনো ধরনেরই অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করলে রক্তচাপ কমে যেয়ে এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণও করতে পারে। এ ধরনের তীব্র অ্যালার্জিক জরুরি অবস্থাকে বলা হয় অ্যানাফাইলেকটিক শক৷

অ্যানাফাইলেটিক শক

অ্যালার্জির তীব্রতা যাচাই করার উপায়

অ্যালার্জি কেন হয় সেটা কয়েকভাবে জানা যায়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অ্যালার্জির উপস্থিতি, অনুপস্থিতি কিংবা তীব্রতা যাচাই করা যায়। রক্ত পরীক্ষায় ইয়োসিনোফিল নামক এক বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকার মাত্রা যাচাইয়ের মাধ্যমে অ্যালার্জির তীব্রতা যাচাই করা যায়। রক্তে ইমিউনোগ্লোবিউলিন-ই এর মাত্রা পরিমাপ করেও অ্যালার্জির উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। সাধারণত অ্যালার্জি রোগীদের ক্ষেত্রে এর মাত্রা বেশি থাকে। স্কিন প্রিক টেস্ট কিংবা প্যাচ টেস্টের মাধ্যমে রোগীর চামড়ার ওপর বিভিন্ন অ্যালার্জেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এ পরীক্ষায় কোন কোন জিনিসে ঐ রোগীর অ্যালার্জি আছে তা ধরা পড়ে। এছাড়া বুকের এক্স-রে এবং স্পাইরোমেট্রি পরীক্ষার মাধ্যমে অ্যালার্জিজনিত শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসের অবস্থা যাচাই করা যায়।

চিকিৎসা

অ্যালার্জি আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মন খারাপের কথা হলো অ্যালার্জির স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। কারণ এটার সম্পর্ক শরীরের ইমিউন সিস্টেমের সাথে। এজন্য যাদের যেসব বস্তু বা খাবারে অ্যালার্জি রয়েছে তা এড়িয়ে চলাই ভালো। অ্যালার্জিতে যেহেতু শরীরে প্রচুর পরিমাণে হিস্টামিন ক্ষরিত হয়, তাই অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অনিয়ন্ত্রিত হিস্টামিন ক্ষরণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর সেজন্য অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধই হলো অ্যালার্জির মূল চিকিৎসা। তবে সকল অ্যান্টিহিস্টামিন সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। বিশেষ ক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে।

আধুনিক ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমেও বর্তমানে অ্যালার্জির চিকিৎসা করা হচ্ছে। সর্বোপরি অ্যালার্জির চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো চিকিৎসা নেওয়া কিংবা হোমিওপ্যাথি বা কবিরাজির মতো বিকল্প ধারার চিকিৎসা গ্রহণ করা বিপজ্জনক হতে পারে। অ্যালার্জিজনিত কোনো শারীরিক সমস্যায় নিকটস্থ চিকিৎসক কিংবা সরাসরি হাসপাতালে যোগাযোগ করাই সবচেয়ে ভালো। প্রতিকারের চেয়ে অ্যালার্জি প্রতিরোধই অ্যালার্জিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রধান হাতিয়ার।

SHOP AT SHAJGOJ

     

    এই তো জেনে নিলেন অ্যালার্জি কেন হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত। আপনার যদি এই সমস্যা থেকে থাকে তাহলে আজই সচেতন হোন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

    ছবিঃ সাটারস্টক, অ্যালার্জিক লিভিং ডট কম

    6 I like it
    1 I don't like it
    পরবর্তী পোস্ট লোড করা হচ্ছে...

    escort bayan adapazarı Eskişehir bayan escort