ফাউন্ডেশন কিনতে গিয়ে একবারের জন্য দ্বিধাগ্রস্থ হননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। স্কিনে স্যুট করবে কিনা, সঠিক শেড পাওয়া যাবে কিনা, দেওয়ার পরে মুখটা কালচে বা তেলতেলে লাগবে কি না, বা আচমকা ব্রণের সমস্যা দেখা দেবে কিনা এমন হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে মনে। আর আমাদের দেশের কম বেশি সব দোকান বা শপিং মলের মেকাপ আইটেম বিক্রেতারা ফাউন্ডেশন এর কোয়ালিটি, ব্র্যান্ড, এক্সপায়ার ডেট, আসল/নকল, শেড ম্যাচিং, ত্বকের ধরন সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা রাখেন না বলে প্রায়শই তাদের কাছে ভালো মন্দ যাই থাকুক তাই গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় থাকে। আর যিনি কিনতে যাবেন তারও যদি খুব বেশি ধারণা না থাকে তাহলে তিনিও বিক্রেতার কথায় বিশ্বাস করে ভুল ফাউন্ডেশন কিনে বাড়ি ফিরে আসেন। পরে আফসোস করতে হয়। অনেকসময় ধারণা থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য ব্র্যান্ড আর শেডের মাঝে দ্বিধায় ভোগেন কেউ কেউ। তাই ফাউন্ডেশন কেনার আগে নিজের ত্বকের ধরন আর ফাউন্ডেশন সম্পর্কে ভালো ভাবে জেনে নিন, ধারণা করে নিন শেডের ব্যাপারেও। কোন ধরনের আপনার ফাউন্ডেশন ত্বকের জন্য প্রযোজ্য তাও জেনে নিন। তারপর কিনতে বের হন আপনার ত্বকের জন্য মানানসই ফাউন্ডেশন।
প্রথমে জেনে নিন আপনার ত্বকের ধরন:
আপনার স্কিন টাইপ নরমাল/সাধারণ যদি নিচের লক্ষণগুলো আপনার ত্বকে থাকে –
- ত্বকে খুব একটা অসামঞ্জস্যতা না থাকে
- ত্বক খুব একটা তৈলাক্তও না আবার শুষ্কও না
- ত্বকের পোরস গুলো ক্ষুদ্র আকারের হয়
- ত্বক টান টান হলেও চোখের নিচে, কপালে আর ঠোঁটের পাশে কিছুটা ভাঁজ থাকে
- খুব কমই পিম্পলের সমস্যা হয়
আপনার স্কিন টাইপ অয়েলি/তৈলাক্ত যদি নিচের লক্ষণগুলো আপনার ত্বকে থাকে –
- পুরো মুখে সবসময় একটা চকচকে ভাব থাকে
- ফেস ওয়াশ বা পাউডার দেওয়ার পরেও চকচকে ভাব ফিরে আসে
- ওপেন/ক্লগড পোরস এর সমস্যা থাকে
- মেকাপের পরে ঘেমে যাওয়ার প্রবণতা বেশি
- ব্রণ, ব্ল্যাকহেডস, হোয়াইটহেডস, এর সমস্যা বেশি
আপনার স্কিন টাইপ কম্বিনেশন/মিশ্র যদি নিচের লক্ষণগুলো আপনার ত্বকে থাকে –
- টি জোন (কপাল ও নাক) তৈলাক্ত হয়
- ত্বকের বাকি অংশ সাধারণ
- গালে, নাকে আর কপালে বেশি ব্রণ হয়
- গালের পোরস গুলো বেশ বড় হয়
- নাকের ত্বক অমসৃণ হয়ে থাকে
আপনার স্কিন টাইপ ড্রাই/শুষ্ক যদি নিচের লক্ষণগুলো আপনার ত্বকে থাকে –
- পোরস গুলো বোঝা যায় না
- ত্বকে অতিরিক্ত টানটান ভাব অনুভূত হয়
- গাল, থুতনি ও নাকের পাশে সাদা মরা চামড়ার (dead skin cell) সমস্যা থাকে
- মুখ ও চোখের চারপাশে হালকা ভাঁজ দেখা যায়
আপনার স্কিন টাইপ সেনসিটিভ/সংবেদনশীল যদি নিচের লক্ষণগুলো আপনার ত্বকে থাকে –
- ত্বক বেশ পাতলা ও নাজুক হয়
- গালে লালচে ভাব থাকে
- কারো কারো ক্ষেত্রে ত্বক বেশ খসখসে হয়
- সাধারণ যেকোনো প্রোডাক্ট ব্যবহার করা মাত্রই ব্রণ, র্যাশ, চুলকুনি জাতীয় রিঅ্যাকশন দেখা দেয়
জেনে নিন আপনার ত্বকের আন্ডারটোন –
আপনি ওয়ার্ম আন্ডারটোন? নাকি কুল আন্ডারটোন? যদি সোনালি গয়না/সোনালি রঙ আপনাকে বেশি মানায় তবে আপনি ওয়ার্ম আন্ডার টোন, আর যদি রুপালি গয়না/রুপালি রঙ আপনাকে বেশি স্যুট করে বলে আপনার মনে হয়, তাহলে বুঝবেন আপনি কুল আন্ডারটোন এর অধিকারী।
এতো গেল ত্বকের ধরনের কথা। এবার জেনে নিন কোন ধরনের ফাউন্ডেশন মার্কেটে পাওয়া যায়, সেগুলো কী রকম কাভারেজ দেয় এবং কোনটা কোন ত্বকের উপযোগী-
১. ক্রিম ফাউন্ডেশন
নরমাল আর ড্রাই স্কিনের জন্য এই ফাউন্ডেশন। তবে চাইলে অল্প তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারীরাও ব্যবহার করতে পারেন। ত্বকের ছোটোখাটো অসামঞ্জস্যতা দূর করতে, দাগ ছোপ ঢেকে দিতে এটি বেশ কার্যকরী। এটি মিডিয়াম থেকে ফুল কাভারেজ দেয়। ফ্ললেস ডিউই ফিনিশ দেয় এই জাতীয় ফাউন্ডেশন গুলো। ব্যবহার করতে হয় ফাউন্ডেশন ব্রাশ বা বিউটি ব্লেন্ডার স্পঞ্জ দিয়ে। ত্বকে খুব বেশি দাগ না থাকলে আলাদা করে কন্সিলার ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়না।
দেশে পাওয়া যায় এমন ক্রিম ফাউন্ডেশন এর মধ্যে রয়েছে Revlon Colorstay Whipped Cream Foundation ও Maybelline Dream Matte Mousse।
২. লিকুইড ফাউন্ডেশন
সব ধরনের ত্বকেই ব্যবহার করা যায়। শুষ্ক ত্বকের অধিকারী রা সারা বছর আর তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারীরা শীতকালে ব্যবহার করতে পারেন। ফাউন্ডেশন এর গায়েই লেখা থাকে এর কাভারেজের ব্যাপারে। লাইট থেকে হেভি; সব ধরনের কাভারেজ দেয়। গ্লসি ফিনিশ, ম্যাট ফিনিশ, স্যাটিন ফিনিশ; এমন ধরনের ফাউন্ডেশন পাবেন বড় দোকান গুলোতে। এতে কিছুটা ময়েশ্চারাইজার থাকে বলে স্মুদ ফিনিশ আসে। ব্যবহার করতে হয় ফাউন্ডেশন ব্রাশ বা স্টিপেল ব্রাশ, অথবা বিউটি ব্লেন্ডার এর সাহায্যে।
দেশে পাওয়া যায় এমন লিকুইড ফাউন্ডেশন এর মধ্যে রয়েছে MAC Studio Fix Foundation, Revlon Colorstay Foundation, Maybelline Dream Matte Liquid Foundation, Maybelline FIT Me! Matte+Poreless Foundation, Maybelline FIT Me! Dewy+Smooth Foundation, Loreal True Match Foundation, Loreal True Match Lumi Foundation, Loreal Infallible Pro-Matte Foundation, Loreal Infallible Pro-Glow Foundation, Loreal Infallible Total Coverage Foundation, L.A. Girl Pro-Coverage Foundation এবং elf Acne Fighting Foundation ব্র্যান্ডের অয়েল ফ্রি ফাউন্ডেশন রয়েছে যেগুলো অয়েলি স্কিনের জন্য ভালো আর গরমকালেও ইউজ করা যায়। আরও অনেক রয়েছে তবে তাদের মধ্যে এগুলো বেশ ভালো।
৩. পাউডার ফাউন্ডেশন
অয়েলি স্কিনের জন্য পাউডার বেসড, বিশেষ করে প্রেসড পাউডার বেসড ফাউন্ডেশন গুলো আদর্শ। এগুলো ম্যাট ফিনিশ, দেয় অয়েল কন্ট্রোল করে, আর লম্বা সময় পর্যন্ত অতিরিক্ত তেল শুষে নিয়ে ত্বকের হালকা দাগগুলো কাভার করে। পাউডার ব্রাশ বা ভেজা বিউটি ব্লেন্ডার স্পঞ্জের সাহায্যে ব্যবহার করতে হয়। লাইট থেকে মিডিয়াম; আবার মিডিয়াম থেকে হেভি সব ধরনের কাভারেজের পাউডার ফাউন্ডেশন পাওয়া যায়। কেমন কাভারেজ চান তার ওপর নির্ভর করে কিনতে হবে।
দেশে পাওয়া যায় এমন পাউডার ফাউন্ডেশন এর মধ্যে রয়েছে MAC Studio Fix Powder foundation, Maybelline FIT me!, Rimmel Stay Matte এবং Loreal True Match।
৪. মিনারেল ফাউন্ডেশন
সেনসিটিভ স্কিনের জন্য আদর্শ এই ফাউন্ডেশন। ক্ষতিকর কেমিক্যাল ছাড়া তৈরি হয় এবং খুব হালকা texture এর হয় বলে ত্বকের সাথে খুব সহজেই মিশে যায়। খুব বেশি পিগমেনট থাকেনা বলে হালকা থেকে মিডিয়াম কাভারেজ দেয়। ত্বককে মেকাপের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি থেকেও কিছুটা রক্ষা করে এই মিনারেল ফাউন্ডেশন। ম্যাট ফিনিশের হয়ে থাকে বলে ইউজ করার আগে সামান্য ময়েশ্চারাইজার এর প্রয়োজন হয়। পাউডার ব্রাশ বা ফ্লাফি টাইপ কাবুকি ব্রাশ দিয়ে স্কিনে এপ্লাই করতে হয়।
দেশে পাওয়া যায় এমন মিনারেল ফাউন্ডেশন এর মধ্যে রয়েছে MAC mineralize Foundation এবং Loreal True Match Mineral foundation।
৫. টিন্টেড ময়েশ্চারাইজার
সেনসিটিভ স্কিন ছাড়া আর সব ত্বকেই ইউজ করা যায়। এটা ময়েশ্চারাইজারের মতই। যাদের ত্বকে লম্বা সময় আর্দ্রতা ধরে রাখার প্রয়োজন হয় তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো। আমাদের দেশের গরমে দিনের বেলায় হালকা ময়েশ্চারাইজারের সাথে কিছুটা ফাউন্ডেশন এর কাজ করে। তাই একই সাথে স্কিন কেয়ার আর মেকাপের কাজটাও হয়ে যায়। লাইট থেকে মিডিয়াম কাভারেজ দেয়, তবে অয়েলি স্কিন হলে এর পরে হালকা ফেস পাউডার দিতে হবে। চটজলদি হালকা মেকাপের জন্য আর এখনকার ট্রেন্ড “নো মেকাপ লুকের” জন্য অনেকেই পছন্দ করছেন এগুলো। সাধারণ ফাউন্ডেশন ব্রাশের সাহায্যে ত্বকে লাগাতে হয়।
দেশে পাওয়া যায় এমন টিন্টেড ময়েশ্চারাইজার আলাদা ভাবে নেই, তাই বিবি আর সিসি ক্রিম কিছুটা টিন্টেড ময়েশ্চারাইজার এর কাজ করে বলে এগুলোর নামই বললাম। The Body Shop Tea Tree BB Cream, Rimmel London BB Cream, Garnier BB Cream, , Maybelline bb Cream, Missha BB Cream, The Body Shop All in One BB Cream, MAC BB Cream এবং Lakme CC Cream।
কিনতে যাবার আগে ও কেনার সময় মাথায় রাখুন এই খুঁটিনাটি টিপসগুলো –
- ইন্টারনেট এর যথাযোগ্য ব্যবহার করুন প্রথমেই। কোন স্কিনের জন্য কোনটা ভালো হবে সে সম্পর্কে গুগল করে জেনে নিন। সাহায্য নিন বিউটি এক্সপার্ট ও বিউটি ব্লগারদের ফাউন্ডেশান সম্পর্কিত পোস্ট থেকে।
- আসল বা নকল সম্পর্কে ধারণা করে নিন, প্যাকেজিং/লেবেল আর দাম দেখলেই বোঝা যায় সেটা। নামি ব্র্যান্ডের নাম দেওয়া অথচ দামে সস্তা? ভুলেও কিনতে যাবেন না।
- আপনি ওয়ার্ম আন্ডার টোন নাকি কুল; সে ব্যাপারে আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন। তবে এশিয়ান স্কিন টোন বেশির ভাগ সময় ওয়ার্ম আন্ডার টোনেরই হয়ে থাকে।
- কাভারেজ কেমন পেতে চান সেটি মাথায় রাখুন, সেই অনুযায়ী কিনুন।
- ফাউন্ডেশন ব্রাশ বা বিউটি ব্লেন্ডার নিয়ে যান সঙ্গে।
- ভালো দোকান থেকে কিনুন। যেসব মার্কেটের সব দোকানেই নকলের ছড়াছড়ি, সেখানে আসল জিনিস পাওয়ার চেষ্টাই বৃথা।
- কেনার সময় হাতে দিয়ে টেস্ট করবেন না; মুখের ত্বকের কিছু অংশে লাগিয়ে দেখবেন। ব্রাশ/ব্লেন্ডার কাজে লাগাবেন তখন।
- আপনার ত্বকের সাথে মানানসই শেড খুঁজে না পেলে ত্বকের চেয়ে একটু হালকা আর একটু গাঢ় শেড নিন, মিক্স করে দেখুন দুটো মিলিয়ে আপনার ত্বকের শেড আসে কিনা। মিলে গেলে নিয়ে নিতে পারেন দুটোই।
- ২০-৩০ মিনিট ফাউন্ডেশন লাগিয়ে রাখার পরে যদি মুখের ওই অংশ কালচে লাগে, তবে বুঝবেন ওটি আপনার জন্য নয়। এক্ষেত্রে সময় হাতে নিয়ে কেনাকাটা করাটা শ্রেয়।
- স্মার্টফোনে বার কোড স্ক্যান করে যাচাই করে নিন প্রোডাক্টের অরিজিনালিটি আর এক্সপায়ার ডেট সম্পর্কে।
লিখেছেন – চৌধুরী তাহাসিন জামান